ডায়াবেটিস: পরিবারের ভূমিকা – ডা. অজিত কুমার পাল
আজ ১৪ই নভেম্বর, ২০১৮। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হচ্ছ। এবারের প্রতিপাদ্য-“ডায়াবেটিসঃ প্রতিটি পরিবারের উদ্বেগ”। এই প্রতিপাদ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে পরিবর্তিত জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসের কারণে প্রতিটি পরিবারই রয়েছে ভবিষ্যৎ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে। তাছাড়া যে সব পরিবারে ডায়াবেটিস আছে তাদেরও ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগে কাটাতে হয়।
বর্তমান বিশ্বে ৪২৫ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা ৬২৯ মিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে। বংলাদেশে বর্তমানে ৭১ লক্ষ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। তাছাড়া শতকরা ৫০ ভাগ মানুষই জানে না যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, এবং প্রতি ৩ জনের ২জনই জানে না যে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় পরিবারের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যান্য জটিল রোগের মত ডায়াবেটিসও একটি পরিবারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। একটুখানি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পরিবারের সদস্যদের থেকে পেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করা আরও সহজ হয়ে যায়। ফিনল্যান্ডের একদল গবেষক তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসায় পরিবার অন্তর্ভূক্ত হলে রোগীদের চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন সফলভাবে হয়ে থাকে। প্রতিদিন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রোগীদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। যেমন: ঘুম থেকে উঠে ঔষধ সেবন বা ইনসুলিন গ্রহণ, সময়মত রক্তের সুগার মাপা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ব্যায়াম ও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। পরিবারের সহায়তা পেলে ডায়াবেটিস রোগীরা এই কাজগুলো করতে উদ্দীপ্ত হন এবং কাজগুলো আগ্রহ সহকারে করে থাকেন।
পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ভাবে ডায়াবেটিস রোগীদের সহায়তা করতে পারে|ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সদস্যদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা উচিৎ। ডায়াবেটিস কোন সহজ রোগ নয়। এই রোগ একবার হলে আর সারে না। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের জন্য জীবনযাত্রায় সুনিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন আনতে হয়| ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কে ধারণা, রোগের উপসর্গ ও লক্ষন সম্পর্কে ধারণা একজনের জন্য যথার্থ সহায়ক হতে পারে| রক্তের উচ্চ শর্করার উপস্থিতির লক্ষন যেমন জানতে হবে তেমনি রক্তের শর্করা কমে গেলে কি করতে হবে তা জানতে হবে। দৃষ্টান্ত স্বরুপ, যদি কোন রোগী অস্বাভাবিক আচরন করে বুঝতে হবে এটা রক্তে শর্করা অতিরিক্ত কমের লক্ষন। ডায়াবেটিক রোগীর পরিবারের সদস্যদের রক্তে শর্করা পরিমাপ করা শিখতে হবে।
পরিবারের সদস্যদের ডায়াবেটিক রোগীর খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। একজন পরিবারের সদস্য এই খাদ্য তালিকা থেকে সাহায্য নিয়ে রোগীকে সাহায্য করতে পারে। অধিকন্তু এই সুষম খাদ্য তলিকা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্যও গ্রহণযোগ্য। ব্যায়াম হলো ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও নিজে ব্যায়াম করার পাশাপাশি রোগীদের জন্য উপযোগী ব্যায়ামের ব্যাপারে সহায়তা করতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীরা (বিশেষ করে যারা নতুন করে এই রোগের সম্মুখীন হয়েছে তারা) বিষন্নতায় ভোগেন। পরিবারের সদস্যদের একটু সহযোগিতার হাত তাদের এই হতাশাজনক অবস্থা ও ভীতির কারণ থেকে মুক্তি দিতে পারে। সঠিক খাদ্যাভাস ও নিয়মকানুন মানার পরেও ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত খাকলে রোগীকে অপবাদ না দিয়ে বরং সহায়তা করা উচিত। পরিবারের সদস্যরা ডায়াবেটিস রোগীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, যাতে তারা সময়মত খেতে পারে, ডায়াবেটিস মাপতে পারে এবং হাঁটতে পারে।
অনেকে মনে করে ডায়াবেটিস একটি ছোঁয়াচে রোগ এবং এইজন্য রোগাক্রান্ত ব্যাক্তিকে এড়িয়ে চলতে চান। তারা একই টুথপেষ্ট, থালাবাসন, গ্লাস ব্যবহার করতে চান না, এমনকি একত্রে বসে খেতে চান না। পরিবারের সদস্যদের এই মনোভাব পরিহার করতে হবে। ব্যস্ত জীবনযাপন, অবহেলা এবং সচেতনতার অভাবে অনেক রোগী সময় মত ডাক্তারের পরামর্শ নেয় না। পরিবারের সদস্যরা এই ব্যাপারে ডায়াবেটিস রোগীদের সহায়তা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন বহুলাংশে সহজতর হয়ে যায়। এভাবে ডায়াবেটিস রোগী ও পরিবারের সদস্যদের যৌথ প্রচেষ্টায় ডায়াবেটিস নির্ণয়, প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং ডায়াবেটিসজনিত জটিলতাগুলো ঠেকানো সহজতর হয়, এবং ডায়াবেটিস রোগীরা দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারেন।
ডা. অজিত কুমার পাল
এমবিবিএস, এমডি, এমআরসিপিএস(গ্লাসগো)
এফএসিই, এফএসিপি(ইউএসএ)মেডিসিন,
ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, ময়নামতি মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা
সিনিয়র কনসালটেন্ট,ডায়াবেটিক হাসপাতাল, কুমিল্লা