কুমিল্লায় লড়াই হবে সমানে সমান
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার চিত্র ফেনীর বিপরীত। বাস থেকে নেমে শহরে ঢুকতেই দেখলাম নৌকা ও ধানের শীষের পোস্টার পাশাপাশি ঝুলছে। কুমিল্লা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাহাউদ্দিন বাহার ও বিএনপির প্রার্থী আমিনুর রশীদ ইয়াসিন গণসংযোগ করছেন। এর আগে বাহার মাদারীপুরে গিয়েছিলেন তাঁর বেয়াই শাজাহান খানের নির্বাচনী প্রচারে।
আওয়ামী লীগের কর্মীরা নৌকার পক্ষে জোর প্রচার চালাচ্ছেন। মাইকিং করছেন। আর বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভয়ভীতিতে আছেন। গত বুধবার বিএনপির দক্ষিণ উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী একটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গেলে জেলখানার ফটকেই তাঁর ওপর হামলা হয়। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিএনপির প্রার্থী আমিনুর রশীদ ইয়াসিন এ জন্য স্বেচ্ছাসেবক ও যুবলীগের দুই নেতাকে দায়ী করেন। তাঁর দাবি, প্রচার শুরুর পর থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের কর্মীদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর করেছেন।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক গাজীউল হককে নিয়ে বৃহস্পতিবার রিকশায় যাচ্ছিলাম আদালতপাড়ায়। রিকশাচালকও এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি দুঃখ করে বললেন, বুধবার রিকশায় ধানের শীষের স্টিকার লাগিয়ে দেন বিএনপির কর্মীরা। রাতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী রিকশা থামিয়ে বললেন, ‘এখানে নৌকা ছাড়া আর কোনো স্টিকার লাগানো যাবে না।’
আদালত প্রাঙ্গণে আলাপ হলো একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁর প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক বিএনপির ক্যাম্প অফিস করার জন্য ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। ২২ দিনের জন্য ভাড়া ৫ হাজার টাকা। কিন্তু ভাড়া দেওয়ার পরদিন দেখেন, রাতে কে বা কারা শাটার ভেঙে ঘরের জিনিসপত্র সব নিয়ে গেছে। পরদিন তিনি বিএনপির প্রার্থীর টাকা ফেরত দিয়েছেন।
যখনই নির্বাচন হয়, কুমিল্লা ক্লাব সরগরম থাকে নেতা-কর্মীদের পদচারণে। ক্লাবের ক্যানটিনে কথা হচ্ছিল বেসরকারি সংস্থার এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ খারাপ। কিন্তু বিএনপি এলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কেননা, তাদের সঙ্গে জামায়াত আছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজত—এটি এখন রাজনীতির নতুন সমীকরণ।
ক্লাব থেকে সামনে এগোতে চায়ের দোকানে দেখি কয়েকজন গল্প করছেন। আমিও সেখানে বসে এক কাপ চা দিতে বললাম। পাশে বসা ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলাম, ভোট কেমন হবে বলে মনে করেন? তাঁর স্পষ্ট জবাব, ‘ভোট কেমন হবে ডিসি-এসপি জানেন। ইসি-মিছি কিছু করতে পারবে না। তারা তো মিনমিন করে কথা বলে। তাদের কথা কেউ শুনছে না।’
এরপর মোটামুটি সেখানে ছোটখাটো বাহাস শুরু হয়ে যায় নৌকা ও ধানের শীষের পক্ষে-বিপক্ষে। একজন বললেন, আওয়ামী লীগ জিততে পারবে না বলেই পুলিশ দিয়ে বিরোধী দলকে ঠ্যাঙাচ্ছে। আরেকজন ত্বরিত জবাব দিলেন, সরকার ১০ বছরে যে উন্নতি করেছে, তাতে ভোট কারচুপির প্রয়োজন পড়বে না। জনগণের ভোটেই আওয়ামী লীগ জিতে যাবে।
বৃহস্পতিবার ক্লাব থেকে সকাল সাতটায় কান্দিরপাড় মোড়ে যেতে দেখলাম ২৫-৩০ জন শ্রমজীবী মানুষ টুকরি-কোদাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কাজের আশায়। আলাপ করে জানলাম, তাঁরা এসেছেন উত্তরবঙ্গ থেকে। মঙ্গামুক্ত হলেও উত্তরবঙ্গে কাজের সংস্থান নেই। ফলে সেখানকার শ্রমিকেরা কাজের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ওই শ্রমিকদের মধ্যে লেখাপড়া জানা মানুষও আছেন। আমার হাতে পত্রিকা দেখে একজন চেয়ে নিয়ে ওই দিনের প্রধান শিরোনামটি পড়লেন: ‘উন্নয়নের ধারা রক্ষায় নৌকায় ভোট চাই’। পাশে দাঁড়ানো এক গেঞ্জি পরা তরুণ বললেন, ‘আমাগো উন্নতি হয়নি। মন্ত্রী-এমপিগো উন্নতি হয়েছে।’ জানতে চাই ভোট দিতে যাবেন কি না। পাশ থেকে একজন বললেন, ‘হ, যামু। ভোট দিতে পারলে দিমু। না পারলে চইলা আমু।’
কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিসে গিয়ে দেখি বেশ ভিড়। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ এসেছেন আর্থিক সহায়তার জন্য। নির্বাচন নিয়ে কথা উঠতেই জেলা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বললেন, ‘আমি রাজনীতি করি না। মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখি।’ তাঁর কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল সংস্কৃতিসেবী শহিদুল হকের বক্তব্যে। তিনি বললেন, সংস্কৃতিকর্মীরা দল করতে পারেন না। তাঁরা আদর্শের জন্য কাজ করেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সত্যিকার বাস্তবায়ন চান, কথামালা নয়।
নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সৈয়দ আবদুল্লাহ রীতিমতো একটি বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। বললেন, শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়ন করছেন। মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে, গ্যাস পাচ্ছে। তাহলে নৌকা জিতবে না কেন? তাঁর প্রত্যুত্তরে কুমিল্লা সিটির সাবেক কাউন্সিলর হারুন উর রশীদ বললেন, মানুষ ভয়ে চুপ করে আছে। সুযোগ পেলে দেখিয়ে দেবে।
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নেতা নাজমুল আলম চৌধুরীর কথায় কুমিল্লার রাজনীতির একটা চিত্র পাওয়া গেল। তাঁর ভাষায়, ‘এখানে নৌকা ও ধানের শীষ দুটিই বিভক্ত। ভোগ-ভাগে জোটে-ভোটে ঐক্য আছে। কিন্তু ত্যাগে-সংগ্রামে ঐক্য নেই। কুমিল্লা সদরের রাজনীতি বড় অদ্ভুত। এখানে দলীয় সম্পর্কের চেয়ে ব্যক্তি সম্পর্ক ও স্বার্থ অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে বিভক্তি দীর্ঘদিনের। এই বিরোধের কারণে বিএনপির জেলা কার্যালয় বন্ধ। আওয়ামী লীগে আফজাল-বাহার দ্বন্দ্বও বহু পুরোনো, যদিও প্রথম পক্ষ এখন অস্তমিত সূর্য। গত সিটি নির্বাচনে সাংসদ বাহার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি বলে মনে করেন আফজালের অনুসারীরা। আবার বিএনপির নেতা ইয়াসিনের অনুসারীদের মতে, মেয়র মনিরুল হকের কর্মীরা নির্বাচনে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।
গত কয়েকটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কুমিল্লায় বেশির ভাগ আসনে যেই দল জেতে, সেই দলই সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে এই জেলায় আওয়ামী লীগ কোনো আসন পায়নি। ২০০৮ সালে বিএনপি জিতেছিল মাত্র দুটি আসনে। এবারে কুমিল্লায় দুই দলেরই জাঁদরেল প্রার্থী আছেন। আওয়ামী লীগ থেকে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ, ব্যবসায়ী নেতা ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন প্রমুখ প্রার্থী হয়েছেন। আর বিএনপির প্রার্থী তালিকায় আছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদ, সাবেক ছাত্রনেতা মনিরুল হক চৌধুরী প্রমুখ। খন্দকার মোশাররফ দুটি আসনে লড়ছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া ও ব্যবসায়ী নেত্রী সেলিমা আহমদের বিপরীতে। রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হককে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে জামায়াতের আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের বিপরীতে।
কুমিল্লা জেলায় মোট ১১টি আসন। শহরের বাইরের আসনগুলোতে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা আরও বেশি ঘটছে। কুমিল্লা-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী কে এম মুজিবুল হক মুরাদনগরে নির্বাচনে প্রচারে এলে তাঁর গাড়িবহরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আক্রমণ করেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরাও পাল্টা আঘাত করলে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ পিছু হটে।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন বিএনপি ৭৩টি স্থানে একযোগে মিছিল বের করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ তাদের ফুল ও করতালি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে। এতেই সম্ভবত আওয়ামী লীগ ভয় পেয়ে গেছে। কুমিল্লায় এবার লড়াই হবে সমানে সমান—জানালেন নাগরিক সমাজের এক প্রতিনিধি।
বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। পুলিশ গায়েবি মামলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। তারপরও কুমিল্লা সুজনের নেতা আলী আকবর প্রধানমন্ত্রী ও সিইসির কথায় ভরসা রাখতে চান। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে।’
সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে, না উল্টো ফল দেবে, সেটি দেখার জন্য আমাদের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো