কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে হলে ছাত্রলীগের টর্চার সেল
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) হলে হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ আরো বেশ কয়েকজন নেতার কক্ষে নিয়ে বৈদ্যুতিক শক এবং লাঠি ও রড দিয়ে পেটানোর মতো ঘটনাও ঘটছে। ‘শিবির-ছাত্রদল নিধন’-এর নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধরে এনে নির্যাতন চালিয়ে তাদের শিবির বা ছাত্রদলকর্মী হিসেবে প্রচার চালানো হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলে তাঁদের জন্য বরাদ্দ কক্ষে নিয়ে বিভিন্ন সময় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষসহ অনুসারীদের কয়েকটি কক্ষে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নির্যাতন থেকে বাদ পড়েন না নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। ছাত্রী হলেও ঘটছে নির্যাতনের ঘটনা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র হল ও একটি ছাত্রী হলে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত একাধিক কক্ষ রয়েছে। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ৩০০১, ৫০০৩, ৩০৩, ৫০১ ও ৫০২; কাজী নজরুল ইসলাম হলের ৪০১, ৪০৬, ৫০৫ ও ৫০৬; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২০৮ ও ৩০৫ এবং নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলের ৫১০ ও ১১৩ নম্বর কক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রিত এসব কক্ষে বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
শিক্ষাবর্ষের শুরুতে নতুন শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের ‘রেফারেন্সে’ হলগুলোর গণরুমে জায়গা পান। নবাগত এসব শিক্ষার্থীকে ‘ম্যানার’ শেখানোর নামে চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী হল ছেড়ে ক্যাম্পাসের বাইরে মেসে থাকতে বাধ্য হন। আর যাঁরা নির্যাতন সয়েও হলে থাকেন তাঁদের ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়। এর বাইরে হলের রাজনৈতিক কক্ষ এবং ছাত্রলীগের পার্টি অফিসেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিশ্ববিদালয়ের বিভিন্ন স্থানে বসে ছাত্রলীগের ‘বিচার বৈঠক’। সেখানে বিচারের নামে পেটানো হয় দলীয় নেতাকর্মীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ৩০০১ নম্বর কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ। অভিযোগ রয়েছে, এই কক্ষে ‘বিচার’ বসিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতন করা হয়। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মহিউদ্দিন নাবিল, ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও জয়নাল আহমেদকে সভাপতির কক্ষে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়। জসিম উদ্দিনকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। অন্যদের লাঠি-রড দিয়ে পেটান সভাপতি ও সম্পাদক এবং ছাত্রলীগ নেতা হাসান বিদ্যুৎসহ ১০-১৫ জন।
মহিউদ্দিন নাবিল বলেন, ‘শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করার পর আমরা সভাপতির কক্ষে গেলে আমাদের ওপর রাতভর নির্যাতন চালানো হয়। এ অবস্থায় ওই দিনই ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হই।’
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ থাকেন ৩০১ নম্বর কক্ষে। অভিযোগ রয়েছে, এ কক্ষে ‘শিবির-ছাত্রদল নিধনের’ নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চলে নির্যাতন। মারধর শেষে তাঁদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম হলে বিভিন্ন সময়ে শাখা ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক তারেকুল ইসলাম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দশম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফয়সাল হাসান, লোকপ্রশাসন বিভাগের অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী তানভীর তমাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদসহ অনেককে মারধর করেন এসব হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ নেতাদের কথামতো চলতে হয়। কেউ অন্যথা করলেই হলের নেতাদের কক্ষে ডেকে শাসানো, এমনকি মারধর করা হয়। গত জানুয়ারিতে হলের ডাইনিং ম্যানেজার লিপি আক্তারকে ৫১০ নম্বর কক্ষে নিয়ে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে মারধর করেন শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আইভি রহমান, ছাত্রলীগ নেতা ইসরাত জাহান জেরিন, অপর্ণা নাথ, আশা আফরীনসহ কয়েকজন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ বলেন, ‘যারা সংগঠনবিরোধী কাজ করেছে তাদের কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগই শাস্তি দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং বিরোধীদের চক্রান্ত। আমার কক্ষে কাউকে কখনো মারধর করা হয়নি। কেউ এমন প্রমাণ দিতে পারলে ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি নেব।’
ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ নিজ কক্ষে বিভিন্ন সময় নেতাকর্মীদের ‘বিচার’ করার তথ্য স্বীকার করলেও আটকে রেখে নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘কারণ ছাড়া কখনোই কাউকে মারা হয়নি। সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিই।’
এদিকে হলে হলে ছাত্রলীগের নির্যাতনের এসব ঘটনা প্রশাসন জানলেও কখনোই দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তবে প্রক্টর কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যখনই কোনো মারধরের ঘটনা ঘটেছে আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ আমলে নিয়ে উভয় পক্ষকে নিয়ে বসে সমাধানের চেষ্টা করেছি। এখানে কোনো দলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি।’
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ