তনু হত্যায় সেই ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ
প্রথমআলোঃ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যায় সন্দেহভাজন হিসেবে যে তিনজনের নাম সিআইডিকে বলেছিলেন তাঁর মা, ১৭ মাস পর তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে টানা তিন দিন সিআইডির একটি দল ঢাকা সেনানিবাসে গিয়ে সন্দেহভাজন আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সিআইডির কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতর পাওয়ার হাউস এলাকায় কালভার্টের পাশের ঝোপ থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। কারা কী কারণে তনুকে খুন করেছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। থানা-পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাত ঘুরে হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জালাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তনুর মা তাঁর মেয়ের হত্যাকারী বলে যাঁদের সন্দেহ করছেন, তাঁদের প্রত্যেককে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখনো জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা এই কাজই আমরা করছি।’ হত্যায় কতজন অংশ নিয়েছে, তা জানা গেছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সেটা বের করার জন্য আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন।
তনুর মা আনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লা সেনানিবাসের তৎকালীন সার্জেন্ট জাহিদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে সিআইডি তাঁদের জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সার্জেন্ট জাহিদ ছাড়াও তাঁর স্ত্রী, সিপাহি জাহিদ ও সার্জেন্ট তাজুলকেও তিনি সন্দেহ করেন। ঘটনার দিন তাঁর মেয়ে তনু ছাত্র পড়ানোর জন্য জাহিদের বাসায় গিয়েছিলেন। খুন হওয়ার মাস তিনেক আগে জাহিদের বাসায় টিউশনি নিয়েছিলেন তনু। ওই বাসায় সিপাহি জাহিদ ও সার্জেন্ট তাজুলেরও যাতায়াত ছিল।
আনোয়ারা বেগমের ধারণা, তনুকে ওই বাসাতেই হত্যা করে পরে ঝোপের মধ্যে ফেলে যায় হত্যাকারীরা। সন্দেহভাজন এই চারজনের কেউই এখন আর কুমিল্লা সেনানিবাসে নেই।
এর আগে গত বছরের ১০ মে আনোয়ারা বেগম কুমিল্লায় প্রথমে সাংবাদিকদের, তারপর সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, সার্জেন্ট জাহিদ ও সিপাহি জাহিদ তনুকে ডেকে নিয়ে যান। এরপর আর তনু ফিরে আসেননি। ওই দুজন এ হত্যায় জড়িত বলে তিনি সন্দেহ করেন।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডির ডিএনএ ল্যাবে পরীক্ষা করে তনুর ব্যবহৃত কাপড় থেকে পৃথক তিন ব্যক্তির বীর্যের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে মৃত্যুর আগে তনু ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এর উল্লেখ ছিল না।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তনুর লম্বা চুল ছিল। কিন্তু মৃত্যুর আগে তাঁর চুল ছেঁটে ফেলা হয়। ঘটনার দিন তনু জাহিদের বাসায় তাঁর ছেলেমেয়েকে পড়াতে গিয়েছিলেন। জীবিত অবস্থায় তাঁর শেষ অবস্থান ছিল সেখানেই। তিনি বলেন, যাঁরা ধর্ষণ করেছেন, তাঁরাই তনুর চুল কেটেছেন বলে মনে হয় না। এ ঘটনায় কোনো নারীর সম্পৃক্ততাও থাকতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির উপমহাপরিদর্শক আবদুল কাহার আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ সম্পর্কে বলার সময় এখনো হয়নি। বিষয়টি তদন্তাধীন। আমরা বহু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। অনেকে ভাবছে আমরা বসে আছি। আমরা আসলে বসে নেই। আমি বলব আমরা অনেক দূর এগিয়েছি।’
গত সেপ্টেম্বরে ‘চাঞ্চল্যকর মামলাসমূহ মনিটরিংয়ে গঠিত উপকমিটি’র বৈঠকে তনু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পুলিশের মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটির বৈঠকে তনুর পোশাক পরীক্ষা করে যে তিনটি ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়, তা সন্দেহভাজনদের সঙ্গে মেলানো হয়েছে কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়।
জানা গেছে, গত বছরের মে মাসে ডিএনএ পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর সিআইডি তনুর নাট্য সংগঠন ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থিয়েটারের পাঁচজন নাট্যকর্মীর সঙ্গে ডিএনএ নমুনা মেলানো হয়। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। সর্বশেষ যে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে ডিএনএ মেলানো হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।
প্রাথমিকভাবে যা জানা গিয়েছিল
তনুর বাবা মো. ইয়ার হোসেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী। তিনি গত বছরের ২১ মার্চ কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এজাহারে বলেন, তাঁর মেয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তনু ২০ মার্চ বিকেল চারটায় বাসা থেকে বের হন। গন্তব্য ছিল ১২ ইঞ্জিনিয়ার স্টাফ কোয়ার্টার ও ৬ বীর স্টাফ কোয়ার্টার। সাধারণত তনু সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাসায় ফিরে আসতেন। ওই দিন বাসায় না ফেরায় তনুর মা আনোয়ারা বেগম ও ভাই আনোয়ার হোসেন তনুকে খোঁজাখুঁজি করেন, কিন্তু পাননি। বাবা ইয়ার হোসেন অফিস থেকে ফেরেন রাত আনুমানিক ১০টা ১০ মিনিটে। মেয়ে বাড়ি ফেরেননি জেনে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসের মিলিটারি পুলিশকে জানান। তারপর ছেলে আনোয়ার হোসেন, এক প্রতিবেশী ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বালক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক শিকদার মোস্তফা কামালকে নিয়ে টর্চলাইট হাতে মেয়েকে খুঁজতে বের হন। তাঁদের খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকে ৩০০-৪০০ গজ দূরে পাওয়ার হাউস এলাকার রাস্তার কালভার্টের ওপর প্রথমে তনুর এক পাটি স্যান্ডেল পাওয়া যায়। এরপর পাশের জঙ্গলে পাওয়া যায় দুটো মুঠোফোন ও প্রবেশ পাস। আরও প্রায় ২০ গজ দূরে ঝোপের ভেতর রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেলে তনুর অচেতন দেহ। মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় সিএমএইচে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশের কর্মকর্তারা তনুর মৃতদেহ পান ২১ মার্চ সকালে। সিএমএইচের জরুরি বিভাগে একটি স্ট্রেচারে তনুর মৃতদেহ চাদরে মোড়া ছিল। পুলিশের তৈরি সুরতহাল প্রতিবেদনে লেখা হয়, তনুর আনুমানিক লম্বা দুই ফুট চুলের বেশির ভাগই ছিল কাটা। বাঁ কানের ওপরের অংশে কাটা ও রক্তের দাগ, পরনের কামিজ ছেঁড়া, ডান হাঁটুর ওপরের অংশের চামড়া ছেলা ছিল। তাঁর পরনের কাপড় ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বালু লেগে ছিল। কিন্তু প্রথম দফা ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ বা ধর্ষণের কোনো আলামত খুঁজে পাননি চিকিৎসকেরা। এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠার পর আদালতের নির্দেশে আবার কবর থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয়। দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পর যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়, তাতে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি।
তনু হত্যার ঘটনা তখন দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। তনুর খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাসহ নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন টানা বেশ কিছুদিন কর্মসূচি পালন করে।