কুমিল্লার কৃতি সন্তান মেজর গণির ৬১তম মৃত্যুবার্ষিকী
বিশেষ প্রতিবেদনঃ বাঙ্গালির আধুনিক সশস্ত্র সামরিক শিক্ষার দ্রোণাচার্য, প্রথম সেনাদল সংগঠক, অনুস্মরনীয় আদর্শ মানুষ, অকাল প্রয়াত মেজর আবদুল গনি ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সরাফত আলী এবং মাতার নাম জোবেদা খাতুন। আবদুল গণি’র জন্মের আড়াই বছর পর তার মাতার মৃত্যু হয়। বৈমাত্রেয় ভ্রাতা সিদ্দিকুর রহমানসহ আবদুল গণি’রা দুই ভাই এবং দুই বোন ছিলেন। আবদুল গণি’র মানস-কাঠামো শৈশবেই মুসলিম মধ্যবিত্তের জীবনচর্যা, অর্থনৈতিক সোপান ও গ্রামীণ লোকজ-সংস্কৃতির আলোকে শক্ত ভিতের উপর গড়ে উঠেছিল। তার জীবনের উষা ও গোধুলিলগ্ন একই মহানুবভ জীবনধারার স্বতঃস্ফুতৃ এক স্মারকচিহ্ন। এই জীবনে কোন স্খলন নেই। বরং প্রভাত সূর্যের মতোই তার শৈশব ছিল আলোকিত জীবনের উন্মেষকাল এবং ভবিষ্যৎ জীবনের দিক দর্শন। মেজর আবদুল গণি’র মধ্যে বাল্য ও কৈশোরে দেশীয় ক্রীড়া চর্চা ও মানবসেবায় অংশগ্রহনের মধ্যদিয়ে নেতৃত্বের সহজাত গুনাবলীর স্ফুরন ঘটে। বাল্য ও কৈশোরের ভাবালুতা ওচপলতা তাকে বিচলিত করেনি। মাতৃহীন এক কিশোর জীবনকে সেবা ও পরোপকারী ব্রতে বিন্যস্ত করে তুলেছিল। মানব সেবার মহোত্তম আদর্শে উজ্জীবিত আবদুল গনি কৈশোরেই জাগতিক স্বার্থপরতার মোহ ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। স্বাত্ত্বিক আবদুল গণি ১৯৩৩ সালে জাতি, ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে দুঃস’, দরিদ্র অভাজন মানুষের সেবা এবং বিপথগামী তরুন সম্প্রদায়কে সুপথে পরিচালনার্থে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামে “সবুজ কোর্তা” বাহিনী গঠন করেন। তিনি এক সময় পাকিস্থান সবুজ সেনার সহ-সভাপতি পদে আসীন হন। সবুজ কোর্তা বাহিনীর অধিনায়ক আবদুল গণি ১৯৩৩সালের ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম আন্ত:জেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ানশীপ অর্জন করে বিভাগীয় কমিশনারের প্রশংসা লাভ করেন। এ সময় তিনি অবাঙ্গালি ম্যাজিস্টেট হামিদ হাসান নোমানীর সংস্পর্শে আসেন।
আবদুল গণি সিদলাই জুনিয়র মাদরাসারয় প্রাথমিক শিৰা সমাপ্তির পর চট্টগ্রাম ইসলমিয়া হাই মাদরাসায় ভর্তি হন। তার চাচা আবদুর রাজ্জাক চট্টগ্রাম আলিয়া মাদরাসার ছাত্র থাকাকালে আবদুল গণিকে চট্টগ্রাম নিয়ে যান। চট্টগ্রাম আলিয়া মাদরাসা ও চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে আবদুল গণি ১৯৩০-৩৩ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। হামিদ হাসান নোমান সিরাজগঞ্জে বদলি হলে আবদুল গণি সেখানে গিয়ে লেখাপড়া করেন। অবশেষে এইচ, এইচ, নোমানীর বদলিকৃত কর্মস’ল খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে আবদুল গণি দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন। এরপর আবদুল গণি কোলকাতায় চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত তার মামা ডাক্তার আবদুস সোবাহানের নিকট অবস্থান করে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তিনি এই কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৩৮ সালে আই.এ. পাশ করেন। তিনি বি.এ. পড়াকালীন তার মামা ১৯৩৯ সালের ৫ এপ্রিল কোলকাতায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরন করেন। তার বড় মামা মৌলভী আবদুল গফুর (বিএ) এসময় টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে মরনাপন্ন হয়ে পড়েন। এই দুরবস্তার মধ্যে আবদুল গণি ১৯৪০ সালে বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিএ পরীক্ষা দেবার পর পরই কোলকাতা ফায়ার বিগ্রেডে প্রথম বাঙালি হিসাবে অফিসার পদে চাকরী লাভ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মাতাল সময়ে ১৯৪১ সালে আবদুল গণি কিংস কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারতীয় পাইওনিয়র কোরে কমিশন লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে লেফটেন্যান্ট থাকাকালীন আবদুল গণি তার মামতো বোন আছিয়া বেগমকে বিবাহ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মার (মায়ানমার) রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর একটি জাপানী ডিভিশন আরাকন অঞ্চলে আক্রমন করলে মেজর আবদুল গণি’র বাহিনী দু’মাসের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অবরুদ্ধ অবস্থায় বিমানযোগে তাদের রসদ সরবরাহ করা হতো। পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্যে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। যুদ্ধ বিরতি ঘোষনার পর মেজর আবদুল গণিকে মাদ্রাজে বদলি করা হয়। তিনি দক্ষিনাত্যের বিশাখা পট্টম, হায়দ্রাবাদ, সেকান্দারবাদ, ও বর্তমানে মুম্বাই নামে পরিচিত স্থানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তির পর তার অধীন রেজিমেন্টকে মুম্বাই থেকে বিশেষ ট্রেনে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আনা হয় এবং বাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মার রণাঙ্গনে তার প্রমাণিত সাহসিকতা ও সমরকৌশল এবং তার অধীন যুদ্ধরত বাঙালি সৈন্যদের বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যের কারনে তিনি বাঙালিদের জন্যে পৃথক একটি রেজিমেন্ট গঠনের চিন্তা করেন। তিনি পর্যবেক্ষন করেনঃ ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীতে বিভিন্ন প্রাদেশিক, জাতিগত রেজিমেন্ট রয়েছে, কিন্তু কোন বাঙালি রেজিমেন্ট নেই। পৃথক বাঙালি রেজিমেন্ট গঠনের দৃঢ়মূল চিন্তায় আবদুল গণি’র সঙ্গে ১৯৪৭ সালের পর নিজ বাসভবনে দীর্ঘ এক বৈঠকে সহমত পোষন করেন, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক জনাব শামসুল হক। তিন দিকে ভারত বেষ্টিত পূর্ব বাংলার প্রতিরৰায় বেলুচ পাঠান-পাঞ্জাবী সৈন্যের বদলে বাঙালির নিজস্ব রেজিমেন্ট এবং বিরোধী দলীয় রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা-ভারত বিভক্তির পর পাকিস্থান পর্বে বাঙালি জীবনে তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে নিখোজ ও পরে মানসিক ভারসাম্যহীন জনাব শামসুল হক রাজনীতিতে সে সময়ে সক্রিয় থেকে কর্মীদল তৈরী করেন এবং সামরিক বিষয়ে বাহিনী গঠনের জন্য আবদুল গণিকে পরামর্শ দেন। বাঙালি জাতি সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় ৰেত্রে নিজেকে প্রশিৰিত ও শিৰিত করতে উদ্যোগী হয়।
জেনারেল স্যার মেজারভী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হলে মেজর আবদুল গণি জেনারেলকে অভিনন্দন জানানোর সময় বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠনের আশা ব্যক্ত করেন। এরপর মেজর আবদুল গণি তার অধীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুটি বাঙালি মুসলিম পাইওনিয়র ইউনিট ১২৬৫ এবং ১৪০৭ কোম্পানীকে পুনর্গঠিত করেন, যা মূলত আজকের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গোড়া পত্তন করেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মরিয়ারটির উৎসাহ ও প্রেরনায় মেজর আবদুল গণি বিচক্ষনতার সঙ্গে পদাতিক বাহিনীর মূল অংশ গড়ে তুলতে বাঙালি জোয়ান বাছাই করতে ঢাকায় কুর্মিটোলায় কাজের সূচনা করেন। ১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বর হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে মেজর আবদুল গণি রেজিমেন্ট গঠনের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভি.জে.ই. প্যাটারসন ঢাকায় বদলী হয়ে আসেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী মেজর আবদুল গণি’র অক্লান্ত ও অদম্য প্রয়াসে, অধিনায়কত্বে লে.কর্নেল ভি.জে.ই. প্যাটারসন আনুষ্ঠানিকভাবে কুর্মিটোলার দারোগা বাগিচায়, বর্তমান সিএমএইচ’র পশ্চিমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের প্রতিষ্ঠা ঘোষনা করেন। মেজর আবদুল গণি’র প্রচেষ্টায় প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্ম হয়। মেজর আবদুল গণি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিক্রুটিং অফিসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য জোয়ান সংগ্রহে কঠোর পরিশ্রম করেন।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন, মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন, মন্ত্রী নবাব হাবিবুলৱাহ বাহার, মন্ত্রী আফজাল খান, মন্ত্রী আবদুল হামিদ খান, ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জেসিওদর উপস্থিতির পর এক চা চক্রে আইয়ুব খান বলেন, From now onwards Bengali soldiers will speak in Urdu and not in Bengali. এতে এক অফিসার প্রতিবাদে বলে উঠেন, ‘Excuse me, sir, in West Pakistan pattan soldiers have been allowed to speak in Postu and Urdu. Similarly our Bengali and Urdu. উত্তেজিত বিগ্রেডিয়ার আইয়ুব খান বলেন, ‘Nonsense, absurd sit-down. ক্যাপ্টেন আবদুল গনি তখন বলেন- Excuse me sir, whatever Major M.T. Hossain has said is not correct. We Bengali soldiers will never speak in Urdu. But in our mother tongue Bengali. কিছুকাল পর ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান এক লিখিত আদেশ জানান-কোন বাঙালি সৈনিক জেসিও এবং অফিসার বাংলায় কথা বলতে পারবে না। এর প্রতিবাদে আবদুল গণি ও এম,টি হোসেন ঐ আদেশ অমান্য করে নির্যাতনের শিকার হয়।
১৯৪৮ ও ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন তার মনে রেখাপাত করে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর চাকুরিতে থেকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন ছিল অসম্ভব। তিনি ১৯৫৩ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করে ৩৮ বছর বয়সে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। জনাব শামসুল হকের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপে সিদ্ধান্ত হয়েছিল চাকরী থেকে অবসর গ্রহণ করে মেজর আবদুল গনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করবেন। কিন্তু তিনি যখন অবসর গ্রহণ করেন, তখন শামসুল হক আর রাজনীতিতে নেই। শামসুল হকের নিস্ক্রিয়তায় এবং তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নীতিগত দূরত্বের কারনে মেজর আবদুল গণি সে দলেও যোগ দেন নি। নেজামে ইসলাম পার্টিতে যোগ দেয়ার জন্য ও বহুবার তাকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগকে নিয়ে নবগঠিত যুক্ত ফ্রন্টে নেজামে ইসলাম পার্টি যোগ দেয়ায় তিনি নেজামে ইসলাম পার্টিতে যোগদান করেননি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি ও তার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ তেমন ছিল না। ইসলাম লীগ গঠনের আগে তিনি ১৯৫৪’র নির্বাচনে মুসলিম লীগের মনোনয়ন চাইলে মুসলিম লীগ তা প্রত্যাখান করেন। ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। কুমিল্লার বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া আসন থেকে সদ্য রাজনীতিতে আসা মেজর আবদুল গণি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থী অধ্যাপক সেকান্দর আলী ভূইয়া এবং যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক মফিজুল ইসলামকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। তিনি অধ্যাপক মফিজুল ইসলামের চেয়ে চার হাজারের অধিক ভোট পান। তিনি নির্বাচনী প্রচারনার সময় বুড়িচং এর পীরযাত্রাপুর গ্রামের সর্বজন সম্মাননীয় পীর, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব মৌলভী সুজাত আলী খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ের বিষয়ে পীরকে প্রশ্ন করলে পীর সাহেব ভবিষ্যদ্বানী করেন যে, মেজর আবদুল গণি বিজয়ী হবেন।
মেজর আবদুল গণি’র রাজনৈতিক মতাদর্শকে চিহ্নিত করা দূরুহ গবেষনার শামিল। তবুও সযত্ন প্রয়াসে তার রাজনীতি ভাবনার মূল কেন্দ্রে ইসলাম, ইসলামী রেনেসা ও ইসলামী আন্দোলনকে চিহ্নিত করা যায়। তিনি ইসলামী দর্শন ও আদর্শ জাতির জীবনে বাস্তবায়নের লক্ষে “ইসলাম লীগ” নামে একটি পৃথক রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দলীয় কর্মী তৈরীর লক্ষে তিনি শামসুল হকের সাপ্তাহিক প্রশিক্ষন মজলিশের মতো প্রশিক্ষন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে স্লোগান সর্বস্ব রাজনীতির বদলে আদর্শের রাজনীতির জন্য তিনি কুমিল্লা শহরে প্রায় ২ একর জমির উপর অবস্থিত বাগিচাগাও এলাকায় স্বর্ণকুটির নামের এক প্রাচীন জমিদার বাড়িতে প্রশিক্ষন কেন্দ্র খুলেছিলেন। জনাব শামসুল হক ও মেজর আবদুল গণি রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে ইসলামী দর্শনের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। মেজর আবদুল গণি ইসলামী রাজনীতি করার মানসে ইসলাম লীগের সূচনা করেন এবং এ জন্যই তার রাজনীতি ও জীবনের মধ্যে সঙ্গতি রৰার কথা বলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদে প্রদেশের জন্য ক্যাডেট কলেজ, সামরিক স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তার জীবদ্দশায় না হলেও তার প্রয়াসের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ ও ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তিনি এলাকার পাহাড়ী বন্যা প্রতিরোধ ও দুযোর্গ মোকাবেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রন বিভাগের শরনাপন্ন হয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় ঘুঙঘুর নদী, শালদা নদী প্রকল্প শুরু করেছিলেন। এলাকার দক্ষিণ দিকের ডাকাতিয়া নদী প্রকল্প তার মৃত্যুর এক বছর পর গ্রহণ করা হয়েছিল। ঘুঙঘুর নদীর প্রকল্পের ফলে ত্রিপুরা পাহাড় হতে নদীনালায় প্রবাহিত দেশের নিম্ন সমতলে সঞ্চিত পানি অবাধে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ থাকায় আকস্মিক পাহাড়ী বন্যায় ফসলী জমি বিনষ্ট হওয়ার আশংকা দূরীভূত হয়। তিনি খাদ্য সমস্যা, উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বেসামরিক প্রতিরক্ষা, বেকারত্ব, সড়ক যোগাযোগ, চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যাবস্থা, সকলের জন্য বাধ্যতামুলক এবং পাঠ্যসূচীতে সামরিক শিক্ষা, পাট খাত জাতীয়করন, প্রশাসন পরিচালনা, পাথর কাজে লাগিয়ে সিমেন্ট কারখানা শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রাদেশিক আইন পরিষদে ব্যবস্থা নেয়ার জোরালো দাবি জানান। ১৯৮১ সালে মেজর আবদুল গনিকে সরকার মানবসেবায় অবদানের জন্য স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত করে।
মেজর আবদুল গনি’র পিতা সরাফত আলী প্রবেশিকা পাশ করার পর নিজের জমিতে কৃষি কাজ নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। সিদ্দিকুর রহমান নামে আবদুল গণি’র এক সৎভাই ছিলেন। আবদুল গণি ১৯৪৩ সালে তার বড় মামার প্রথমা কন্যা আছিয়া বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি দুটি পুত্র ও ৩ টি কন্যা সন্তানের জনক। জ্যেষ্ঠ পুত্র কর্নেল তাজুল ইসলাম গণি (অবঃ) এবং কনিষ্ঠ পুত্র লে. কর্নেল আবদুল খালেক গনি (অবঃ) কন্যাত্রয় হলেন মাহমুদা বেগম, হাসিনা বেগম, এবং সাজেদা বেগম। মেজর গণি’র মৃত্যুর পর তার স্ত্রী আছিয়া গণি কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়ায় মেজর ভিলা নামে একটি টিনসেড বসত বাড়ি নির্মান করেন। বর্তমানে আছিয়া গণি ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন।
১৯৫৭ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত জার্মানীর বার্লিনে বিশ্ব ভেটার্যান সম্মেলনে (সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের একটি সংগঠন) পূর্ব পাকিস্তান থেকে মেজর আবদুল গনি এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মেজর গুলজার খান যোগ দেওয়ার জন্য মনোনীত হয়ে গমন করেন। পাকিস্তান সরকার এক পর্যায়ে মেজর আবদুল গণি’র মনোনয়ন বাতিল করেছিলেন। এ সময় সরকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিদেশ গমনও বাধ্যগ্রস্ত করেন। মেজর আবদুল গনি সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে জেদের বশে সিদ্ধান্ত অটল থাকেন। সম্মেলনের শুরুতে পাকিস্তানে গিয়ে তিনি তার পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন। তিনি ব্রঙ্কাইটিস নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বার্লিনের এক হাসপাতালে মৃত্যুবরন করেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তার মৃতদেহ দেশে আনতে অস্বীকৃতি জানালে রাওয়ালপিন্ডিতে কর্মরত আতাউল গনি ওসমানী দৃঢ়ভাবে জানান যে, প্রতিরক্ষা পরিদপ্তর মৃতদেহ দেশে আনার খরচ বহন করবে এবং তা সম্ভাব না হলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা চাদা তুলে মৃতদেহ আনার ব্যবস্থা করবে। তার মতকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন মেজর জেনারেল ওমরাও খান এবং কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক, পটুয়াখালীর কৃতি সন্তান এম, কেরামত আলী সিএসপি। পরে অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার এই ব্যয় বহন করেন।