কুমিল্লায় আসামিকে ‌‌‌‘বাঁচাতে’ গিয়ে ফাঁসছেন ২ তদন্ত কর্মকর্তা

বাড়িতে ভাংচুর, হামলা, মারধর ও চাঁদাবাজির মামলা থেকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতাকে অনৈতিকভাবে অব্যাহতি দিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন পুলিশের দুই তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্তে গাফিলতির কারণে এরই মধ্যে এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একজনকে বদলি করা হয়েছে খাগড়াছড়িতে।

অভিযোগ উঠেছে, কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সরকার মাহমুদ জাবেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। দুজনই তদন্ত শেষে মামলার প্রধান আসামি সরকার মাহমুদ জাবেদকে অব্যাহতি দিয়ে চার্জশিট জমা দিয়েছিলেন। যদিও পরে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে ওই আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সেই সঙ্গে দুই তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও উঠে এসেছে।

জানা গেছে, গত বছরের ২৩ মার্চ কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ধানমন্ডি সড়কের বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল আলম তাঁর বাড়িতে ভাংচুর, হামলা, মারধর ও চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে সরকার মাহমুদ জাবেদসহ তাঁর আট অনুসারীর বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কোতোয়ালি থানা-পুলিশকে এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করতে আদেশ দেন।

মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান কোতোয়ালি থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ আলম পাটওয়ারী। মামলার বাদী তদন্ত কর্মকর্তাকে ওই হামলার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্টসহ বিভিন্ন আলামত সরবরাহ করেন। গত ১৩ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাসুদ আলম পাটওয়ারী প্রধান আসামি ও আওয়ামী লীগ নেতা সরকার মাহমুদ জাবেদসহ চারজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তিনি তদন্তে চাঁদাবাজি, ভাংচুর ও মারধরের কোনো ঘটনা পাননি বলে উল্লেখ করেন। অথচ সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে কামরুল হাসান নামে একজনকে দেখা যায়। তারা সড়কে থাকা লোকজনকে মারধর করে, দোকানপাটে লাথি মারতে থাকে, সব দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করে। দুজন মনিরুল আলমের বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ওপরে থাকা সিসি ক্যামেরা খুলে নিয়ে যায়। ওই হামলায় অংশ নেওয়া ১০ থেকে ১৫ জনকে দেখা গেলেও তদন্ত কর্মকর্তা প্রধান আসামিসহ অধিকাংশকে বাদ দিয়ে মাত্র চারজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেন।

এই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেন বাদী মনিরুল আলম। এরপর আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় কুমিল্লা জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করেন। তিনি গত বছরের ৭ জুলাই তদন্ত শেষে আদালতে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেন। এই তদন্ত কর্মকর্তা হামলায় অংশ নেওয়া নতুন তিনজনকে আসামি করেন। তবে এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি ও আওয়ামী লীগ নেতা সরকার মাহমুদ জাবেদকে বাদ দিয়ে দেন।

দুই তদন্তেই পক্ষপাতিত্ব হয়েছে দাবি করে বাদী মনিরুল তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। পুলিশ সদর দপ্তর তাঁর অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম অভিযোগটি তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি তদন্ত করে এসআইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও অবহেলার সত্যতা পান। এ বছরের ৬ মার্চ এএসপি জাহিদুল ইসলাম তাঁর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এজাহারভুক্ত ১ নম্বর আসামি সরকার মাহমুদ জাবেদ, ৪, ৬ ও ৮ নম্বর আসামির স্পষ্ট উপস্থিতি থাকার পরও তাঁদের চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাসুদ আলম পাটওয়ারী। তিনি তাঁর ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও গাফিলতি করেছেন। এই এসআইয়ের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

দায়িত্বে অবহেলা ও অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে এসআই মাসুদ আলম পাটওয়ারী বলেন, ‘আমি মামলার তদন্ত করে যা পেয়েছি, সে অনুযায়ী চার্জশিট দিয়েছি। এরপর বাদী অভিযোগ করেছেন, আমি বদলি হয়েছি।’

এদিকে পিবিআইয়ের চার্জশিটের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৭ আগস্ট মনিরুল আলম পুনরায় আদালতে নারাজি দেন। এবার মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। সিআইডির কুমিল্লা জেলার পুলিশ পরিদর্শক মো. ইমরুল হাসান মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি তদন্ত শেষে আদালতে আওয়ামী লীগ নেতা সরকার মাহমুদ জাবেদসহ আট আসামির বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেন। আগের দুই কর্মকর্তার তদন্তে হামলায় জাবেদের সম্পৃক্ততা না থাকলেও সিআইডির তদন্তে জাবেদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে। বর্তমানে জাবেদ জামিনে রয়েছেন।

সূত্রঃ আজকের পত্রিকা

আরো পড়ুন