অন্যরকম এক শিক্ষানুরাগী কুমিল্লার মোশাররফ
ডেস্ক রিপোর্টঃ উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যাকে জীবিকার সন্ধানে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, ছোট ভাইবোনের দায়িত্ব ছিল কাঁধে, তার পক্ষে কতটা শিক্ষানুরাগী হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ এমনই একটি প্রশ্নের জলজ্যান্ত উদাহরণ কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ধান্যদৌল গ্রামে জন্ম নেওয়া মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী। কিন্তু তার হাতে গড়ে উঠেছে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এক রূপকথার গল্পের নায়ক মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী। তিনি নিউইয়র্কে ট্যাক্সিক্যাব চালান, কখনো ফাস্টফুডের দোকানে ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। উদ্দেশ্য একটাই, কোনো মতে দিন কাটিয়ে টাকা জমাতে হবে। জনহিতকর কাজে লাগাতে হবে নিজের ঘাম ঝরানো অর্জন।
১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী ও মোসাম্মাৎ আশেদা খাতুন চৌধুরী দম্পতির ঘরে প্রথম সন্তান মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী জন্ম নেন। ১৯৭৪ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী মারা যান। ৬ সন্তানকে বুকে নিয়ে মায়ের সংগ্রামী পথচলা দেখেছেন মোশাররফ। চাচাদের সহায়তায় কোনো মতে দিন চলে তাদের। ১৯৮৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর কাতারে চলে যান জীবিকা নির্বাহের তাগিদে। ১৯৮৯ সালে দেশে এসে ধান্যদৌল গ্রামে বাবার নামে আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। এরপর ১৯৯৪ সালে আম্মা ও দাদির নামে আশেদা-জোবেদা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। এর ৫ বছর পর ১৯৯৯ সালে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরে মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সেখানে ১০টি বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বর্তমানে ৩ হাজার শিক্ষার্থী সেখানে পড়ছে। একই বছর এই উপজেলা সদরে আবদুল মতিন খসরু মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বর্তমানে সেখানে ছাত্রীর সংখ্যা ৫০০-এর উপরে। ২০০২ সালে মুমু রোহান কিন্ডার গার্টেন নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেখানে ছাত্রছাত্রী ৩০০ জন। গরিব ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানে সহায়ক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, ২০১০ সালে কুমিল্লা তিন নামে পরিচিত ব্রাহ্মণপাড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল নির্মাণে দান করেন ১ বিঘা জমি।
শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখা এই মানুষটি অনুপ্রেরণা হিসেবে নেন নিজের বাবা ও বাবার দাদাকে। ১৯৩৭ সালে নিজ গ্রামে ধান্যদৌল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তার বাবার দাদা মরহুম সিরাজ খান চৌধুরী। স্কুল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নিজে ছিলেন সেখানকার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে। ১৯৫৭ সালে মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর বাবা মরহুম আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী রাঙামাটির মতো দুর্গম এলাকায় জ্বালেন শিক্ষার আলো। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিজের এলাকা থেকে শিক্ষক নিয়ে গিয়ে সেখানে চাকরি দেন।
শিক্ষার আলো বিলিয়ে যার তৃপ্তি, সবসময় তিনি চেয়েছেন নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনই যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে না চলে। অর্থ উপার্জনে বার বার ছুটে গেছেন দেশের বাইরে। তবু সবসময় মন পড়ে থেকেছে তার সন্তানতুল্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। সেখানে থেকেও তদারকির অভাব রাখেননি। আর তাই তো প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এমপিওভুক্ত হয়েছে। পেয়েছে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি আর তার প্রচেষ্টা মিলে এমন একটি মহৎ উদ্দেশ্য দিন দিন সফল হয়েছে। তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছানো। কোনো রকম আর্থিক লাভের আশা না করেই নিজের সব উপার্জন ঢেলেছেন এসবের পেছনে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হওয়ায় তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পদে আছেন। মোশাররফ বলেন, ‘মূলত বাবার স্কুল গড়ার স্বপ্নকে আমি একে একে বাস্তবে রূপ দিয়ে চলেছি’।
২০১৪ সাল পর্যন্ত মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটি কুমিল্লা বোর্ডের সেরা ২০-এর মধ্যে ছিল। বর্তমানে রেটিং পদ্ধতি না থাকলেও ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হার থাকে ৯৪.১৬%। আবদুল মতিন খসরু মহিলা কলেজে পাসের হার ৯৮% এবং আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ে পাসের হার ৮৬% হয়। এলাকাবাসী তাকে সবসময় স্মরণ করে পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি শতবর্ষী বটগাছের কারণে। বটগাছটি ব্রাহ্মণপাড়া মন্দিরের পাশে জন্মানো এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় গাছ। মন্দিরের কাজে বিক্রি হলে গাছটি রক্ষায় এগিয়ে আসেন মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী। তিনি চাননি অতি প্রাচীন গাছটি মারা পড়ুক। তার উদ্দেশ্য ছিল এলাকার সবচেয়ে পুরাতন এই গাছটি টিকে থাকুক আরও যত দিন তার আয়ু আছে। তখন ১ লাখ টাকায় গাছটি কিনে মন্দির ও গ্রামের স্কুলকে স্বত্ব দান করেন। প্রাকৃতিকভাবে মারা যাওয়ার পর উভয়ে সমান ভাগ পাবে। শুধু এগুলোই না, গরিবদের সহায়তা, গৃহহীনের ঘর করে দেওয়া, মসজিদ নির্মাণে দান সবই তার স্বভাবের মধ্যে পড়ে। অসাধারণ অমায়িক ব্যবহারের এই মানুষটি দান করেই তৃপ্ত। তার কাছে জানতে চাওয়া হলো আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তিনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে সরল উত্তর দিলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা আরও কীভাবে মানসম্মত করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা’। তার কাছে জানতে চাওয়া হলো অন্যদের মতো পারিবারিক ভোগবিলাসে জীবন না কাটিয়ে দুই হাত ভরে দান করার মূল মন্ত্র কী? সহজ কথা, ‘সবাই দান করতে পারেন না। আল্লাহ যার পক্ষে থাকেন, প্রকৃতিও তার পক্ষে থাকে। তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন তাই এতকিছু করতে সক্ষম হয়েছি’। মোশাররফের দাবি, ‘এমন ত্যাগ শুধু আমি নই, বঙ্গবন্ধুও করেছেন, মহাত্মা গান্ধীও করেছেন। কাউকে তো করতেই হয়, নইলে পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে গড়ে উঠবে’।
মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীর মানবসেবা করার নেশাটা ছিল পারিবারিকভাবেই। পৈতৃকভাবে সম্পদশালী হলেও তিনি নিজের আয়ের প্রতি ছিলেন সচেতন। সে কারণেই বিদেশে পাড়ি জমানো। পরিবার-পরিজন নিয়ে আরাম-আয়েশের জীবন কাটাতে চাননি একদমই। তাই তো স্ত্রী-সন্তানদের দেশে রেখে বিদেশের বুকে মেসের জীবন পার করেছেন। নিজ উপার্জিত অর্থ জমিয়ে এলাকার শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে একের পর এক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে গেছেন। চাইলেই ঢাকা শহরে ৮ থেকে ১০টি বাড়ি, দামি গাড়ির মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুবই সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন। ত্যাগের মহিমায় তাদেরও অংশগ্রহণ রয়েছে সমানভাবে।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন