‘২৯০ আসনে আ.লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী করতে পারব’- হাসিনাকে পাটোয়ারী

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, সেনাপ্রধান, স্বরাষ্ট্র সচিব, নির্বাচন কমিশনের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব।
বৈঠকে সবাই যার যার বাহিনীর শক্তি ও সক্ষমতা নিয়ে কথা বলেন। সবশেষে তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘আমি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করে দিতে পারব। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ২৯০ আসনে বিজয়ী করে আনতে পারব।’
বৈঠকে তিনি আরো বলেন, মাঠপর্যায়ে পুলিশের সবচেয়ে বেশি ফোর্স মোতায়েন থাকে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক অনেক দিনের। সব ভোটকেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন থাকায় কাজটি ভালোভাবে (ভোট ডাকাতি) করা যাবে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের তত্ত্বাবধানে পুলিশের একটি অ্যানালাইসিস টিম কাজ করছে। তাদের কাজ প্রায় শেষ। বাংলাদেশের কোন কেন্দ্রে কত ভোট ‘কাস্ট’ করতে হবে, এটা পুলিশের এই টিম ইতোমধ্যে পর্যালোচনা করেছে।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা চাকরি হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশ না করে বলেন, জাবেদ পাটোয়ারী সেখানে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সঙ্গে এক ধরনের বার্গেইন করে ‘পুরো অপারেশনটি’র (ভোট ডাকাতি) দায়িত্ব নিয়ে নেন।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কপোতাক্ষ’ নামে একটি কক্ষ আছে। এটি সাধারণ অফিসরুম হলেও ২০১৮ সালের অক্টোবরে ব্যবহার করা হয় অস্বাভাবিক কাজে। সেখানে বসে একদল পুলিশ কর্মকর্তা তৈরি করে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও পরিকল্পিত ‘ভোট ডাকাতির’ নীলনকশা।
কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার এবং প্রজেক্টরে সাজানো ওই কক্ষে তারা বিশ্লেষণ করেন ১৯৯১, ’৯৬, ’০১ ও ’০৮ সালের নির্বাচনের সব কেন্দ্রের ভোটের প্যাটার্ন (নমুনা)। ‘রাতের ভোট’খ্যাত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারিগরদের নিয়ে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এএসপি থেকে ডিআইজি পর্যন্ত যারা বিভিন্ন সময় (ওই বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর) পুলিশ সদর দপ্তরের ওই কক্ষে বসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির ছক আঁকেন, এমন ৫৪ কর্মকর্তার তালিকা কাছে এসেছে। তাদের সবাই কপোতাক্ষের ওই বৈঠকগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে নিশ্চিত করেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি ওই প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তবে গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তিনি নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি।
এর আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) একটি গোপন প্রতিবেদনে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংস্থাটির তৎকালীন ডিআইজি (পলিটিক্যাল) মাহবুব হোসেন নেতৃত্বাধীন দলের প্রস্তুত করা রিপোর্টে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে মাত্র ১৪ আসন পেতে পারে।’ আর ওই প্রতিবেদনই হয়ে ওঠে ভোট ডাকাতির মূল উপলক্ষ।
কী ছিল ওই প্রতিবেদনে
এসবি কর্মকর্তা মাহবুবের ওই রিপোর্টের পর ভোট ডাকাতি করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে একটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। ওই টিমে ছিলেন- ঢাকা সিটি এসবির ডিআইজি মোহাম্মাদ আলী মিয়া, এজেডএম নাফিউল ইসলাম, ঢাকা রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (পলিটিক্যাল), বিশেষ পুলিশ সুপার (পলিটিক্যাল), ঢাকা এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার (গোপনীয়), পলিটিক্যাল শাখার সব অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার এবং সহকারী পুলিশ সুপার।
‘টিম জাবেদ’-এর সদস্য কারা
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, জাবেদ পাটোয়ারীর একটি বিশ্বস্ত টিম ছিল, যে টিমের সদস্যরা সব গোপন কাজ করতেন। ভোট ডাকাতির নীলনকশা তৈরিতেও ভূমিকা ছিল ওই দলের। সেটি পরিচিত ছিল ‘টিম জাবেদ’ নামে।
ওই কোর টিমের সদস্য ছিলেন এসবির ডিআইজি (পলিটিক্যাল) মাহবুব, সিটিটিসির (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) মনিরুল ইসলাম, এসবির অ্যাডিশনাল আইজিপি (পলিটিক্যাল) এজেডএম নাফিউল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি (টিঅ্যান্ডআইএম) কাজী জিয়া উদ্দিন, এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার (গোপনীয়) মিজানুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (এলআইসি) এএফএম আনজুমান কালাম, এআইজি (অ্যাডমিন) মিলন মাহমুদ, এআইজি (আরঅ্যান্ডসিপি-১) মোহাম্মাদ মাহফুজুর রহমান আল-মামুন, পুলিশ সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসার টু আইজিপি মাসুদ আলম, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুনসুর আলম কাদেরী এবং কাজী মো. সালাহউদ্দিন।
সূত্র-আমারদেশ।
