নতুন প্রজন্ম জানে না কুমিল্লার বধ্যভূমির ইতিহাস
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লাজুড়ে রয়েছে কমপক্ষে ৫০টি বধ্যভূমি। আবার অনেকের মতে, বধ্যভূমির সংখ্যা ৬০ এর অধিক। এদের অনেকটিরই চিহ্ন নেই। বধ্যভূমিগুলোতে সমাহিত শহীদদের সংখ্যাও কারও জানা নেই। নতুন প্রজন্মের সিংহভাগই জানে না এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও ভয়ানক স্মৃতির কথা। কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল প্রায় ৩২টির মতো বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে ফলক উন্মোচন করেছেন।
রামমালা বধ্যভূমিঃ নগরীর রামমালা এলাকায় অবস্থিত সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভিতরে পুকুর পাড়ে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাক হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ চালায় তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভেতরে আশ্রয় নেয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে গণহারে সাধারণ মানুষ, আনসারদের হত্যা করে। পর গর্ত করে গণকবর রচনা করে যায় হানাদার বাহিনী।
স্থানীয় সূত্র মতে, এই বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫শ’ লোকের সমাধি। কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমিঃ সদরের পাচঁথুবী ইউনিয়নে কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় এলাকায় এ বধ্যভূমিটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে দুপুরে এই এলাকায় বসবাসরত শিশু-নারী, কৃষকসহ ৩৭ জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে নির্বিচারে হত্যা করে ঘাতক হানাদাররা। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১৬ জুন জায়গাটি চিহ্নিত করে এখানে একটি স্মৃতি ফলক স্থাপন করে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদ হাছান। এটি চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে আর কোনো সংস্কার হয়নি। বেলতলী বধ্যভূমিঃ ৭১ এর যুদ্ধকালীন সময়ে কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে দক্ষিণে বেলতলীর এ বধ্যভূমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার বাঙ্গালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর মরদেহ মাটি চাপাঁ দিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। পাক সেনাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের নিরব স্বাক্ষী লাকসাম রেলওয়ে জংশন কলোনির শ্রীধাম চন্দ্র দাশ তার মামা সুরেন্দ্র দাস ও উপেন্দ্র দাস জানান, পাক বাহিনী ওইসময় সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে নারী-পুরুষের হাজার হাজার মরদেহ নিয়ে বধ্যভূমিতে গর্ত করে মাটি চাপাঁ দিয়েছে।
কুমিল্লা সেনানিবাসের এমআর চৌধুরী গ্রাউন্ডের পাশের বধ্যভূমিঃ ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙ্গালি সেনা কর্মকর্তা, সেনা সদস্য, সেনানিবাসে অবস্থানরত বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং কুমিল্লা শহর থেকে ধরে নেওয়া ব্যক্তিবর্গসহ প্রায় ৫ শতাধিক লোককে সেনানিবাসে হত্যা করা হয়। তবে এ বধ্যভূমিটি সংস্কার করে ভালভাবে রেখেছে সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ।
দেবিদ্বার বধ্যভূমিঃ দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাক বাংলোর সামনে অবস্থিত বধ্যভূমিটি পাক হায়ানাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষী । ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই পাক হায়ানারা মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৪২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে অনেক নারীও নির্যাতনের শিকার হন। পরে আরও ১৯ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে ওই গর্তে মাটি চাঁপা দেওয়া হয়েছিল।
নাঙ্গলকোট বধ্যভূমিঃ নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমিতে নোয়াখালী, নাঙ্গলকোট ও আশেপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করে তিনটি কবরে গণ সমাহিত করে পাক হানাদার বাহিনী। এ বধ্যভূমিতে কতজনের মরদেহ সমাহিত হয়েছে তা অজানা রয়ে গেছে।
চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারাঃ ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা নামক স্থানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীরযোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। বেতিয়ারার শহীদদের কবরটি এখন পূর্বের স্থানে নেই। বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ধোয়াঁশা কাটেনি সদর দক্ষিণের জগতপুর গণকবর নিয়েঃ স্বাধীনতার এত বছর পরও সদর দক্ষিণ উপজেলার জগতপুর গণকবরের মরদেহের পরিচয় নিয়ে ধোয়াশা কাটেনি। যাত্রীবাহি বাসে হামলার ঘটনায় নিহত ওইসব বেওয়ারিশ মরদেহ পরিচয় নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মত। কারও কারও মতে ওই বাসে রাজাকাররা পালাচ্ছিল। আবার অনেকের দাবি বাসে ব্যবসায়ীসহ মুক্তিকামী মানুষ ছিল। আবার অনেকে বলছেন রাজাকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ছিল। সব মিলিয়ে বিষয়টি এখনো অমিমাংসিত ইস্যু। ইতিমধ্যে সড়ক সম্প্রসারণ করায় গণকবরের কিছু অংশ সড়কের নিচে পড়ে যায়। তবে মরদেহ পরিচয়গুলো পাওয়া যায়নি।
নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা বধ্যভূমির ইতিহাসঃ কুমিল্লা জেলার নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীর কাছে জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও ভয়ানক স্মৃতির কথা অজানা রয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বিএসএসের শিক্ষার্থী সাইফ উদ্দিন বলেন, আমরা সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভিতরের পুকুর পাড়ে প্রায় আড্ডা দেই। একটি কবরের মতো দেখি। এ বধ্যভূমির ইতিহাস আমাদের অজানা। কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও জেলা প্রশাসনের উচিত প্রত্যেকটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে এর ইতিহাস ফলকে লিখে দেওয়া। এতে করে আমরা নতুন প্রজন্মরা এর ইতিহাস জানতে পারবো।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল, প্রায় ৩২টির মতো বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে ফলক উন্মোচন করা হয়েছে। চেষ্টা করছি বধ্যভূমির ইতিহাস টিকিয়ে রাখার জন্য।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকস (ডিসি) মো. আবুল ফজল মীর বলেন, সবার সহযোগিতা নিয়ে জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা হবে। এগুলোর সংস্কার করে ফলক উন্মোচন করা হবে। পাশাপাশি এগুলোর ইতিহাস লিখে আগামী প্রজন্মকে অবহিত করা হবে।
সূত্রঃ বাংলানিউজ