লতাপচা পানিতে ‘সর্বরোগের চিকিৎসা’ করান দুলাল কবিরাজ

ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর গ্রাম। এই গ্রামেই ডন্ড কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পালের বাড়ি। পাশের রাাজার বাজারে তার একটি দোকানও (চেম্বার) রয়েছে। সেখানে বসেই সর্বরোগের চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা চালান তিনি। সরেজমিনে ওই কবিরাজের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো পাকা দালানের পাশেই টিনসেড একটি ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছিলো পচা দুর্গন্ধ। যদিও কবিরাজের স্ত্রী প্রথমে জোর গলায় বলছিলেন ঘরটি খালি। তবে এক পর্যায়ে স্থানীয়দের চাপে টিনসেড ঘরটির দরজা খুলতে বাধ্য হলেন তিনি। এরপর দেখা গেলো ওই ঘরের মধ্যে বড় বড় প্রায় ২০টি পাস্টিকের ড্রাম। এসব ড্রামের প্রায় সব ক’টি লতা-পাতার পচা পানিতে ভরা। আর এই পচা পানি খাইয়েই গত প্রায় ২০ বছর ধরে সর্বরোগের চিকিৎসার নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছেন ওই ভন্ড কবিরাজ। প্রতারক দুলাল চন্দ্র পাল আবদুল্লাহপুর গ্রামের হুগুন্ড চন্দ্র পালের ছেলে। তিনি এলাকায় ‘ভয়ংকর কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পাল’ নামেও পরিচিত।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার মিয়ারবাজার-কাশিনগর সড়কে রাজার বাজারে ডন্ড কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পালের একটি চেম্বার রয়েছে। ‘বিশুদ্ধ আয়ূর্ব্বেদ প্রদীপ ঔষধালয়’ নামের ওই চেম্বারে প্রতিদিন রোগীদের চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দেন তিনি। ওই চেম্বারের সাইনবোর্ডে নিজের ডিগ্রী হিসেবে ডন্ড কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পাল লিখেছেন, ‘এইচ.এস.সি ব্যকরণ বিদ্যা ভুষন’। পাশাপাশি অসংখ্য রোগের নাম লিখে উল্লেখ করেছেন তিনি এসব রোগের চিকিৎসক। স্থানীয় অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত হয়ে এখন আর ওই ভন্ডের চিকিৎসা নেন না। তার বেশিরভাগ রোগী আসে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে, দালালের মাধ্যমে।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানায়, কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পালের চিকিৎসার পুরোটাই ভন্ডামি। সে বিভিন্ন এলাকায় দালালের মাধ্যমে তার সর্বরোগের চিকিৎসার কথা প্রচার চালিয়ে থাকেন। এছাড়া তার নিজস্ব কিছু লোক আছে যারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বলে তার চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এসব কথা শুনে গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো ছুঁটে আসেন দুলাল চন্দ্র পালের কাছে। তার রোগীদের বেশিরভাগাই মহিলা। আর রোগী এলেই সুযোগ বুঝে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন ওই ভন্ড কবিরাজ।

সরেজমিনে দিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে ড্রামের মধ্যে জমিয়ে রাখা ওই পচা পানি বোতলে ভরে চেম্বারে সাজিয়ে রেখেছেন ভন্ড কবিরাজ দুলাল। এরপর বোতলের গায়ে লেভেলও লাগিয়েছেন তিনি নিজেই। সেখানে উৎপাদন তারিখ, মেয়াদ, রেজিস্টেশন নম্বরও নিজের মনগড়া মতো বসিয়ে দিয়েছেন তিনি।

স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা মো.সেলিম মিয়া বলেন, কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পাল পুরাই ভন্ড ও প্রতারক। সে এসব অপচিকিৎসা চালিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। এলাকার মানুষও তার প্রতারণা থেকে বাদ যায়নি। এখন প্রতিদিনই দুর-দুরান্ত থেকে আসা রোগীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। প্রতারিত হতে হতে স্থানীয়রা এখন আর তার চিকিৎসা নেন না।

মোস্তফা কামাল নামের আরেক ব্যক্তি জানান, ভন্ড কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পালের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষ অনেকবার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু সে স্থানীয় এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। এছাড়া প্রশাসনের লোকেরা এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় ওই ভন্ড আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে।

আসমা বেগম নামে এক গৃহীনি জানান, একবার স্থানীয়দের কাছে শুনে আমার একটি সমস্যা নিয়ে ওই কবিরাজের কাছে যাই। পরে তিনি আমাকে কয়েক বোতল ওষুধ দেন। তার পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত ওই ওষুধ খাওয়ার পর আমার ডায়রিয়া শুরু হয়। এছাড়া আরো অনেক সমস্যা দেখা দেয় আমার শরীরে। ওই কবিরাজ একজন ভন্ড ও প্রতারক বলেও জানান তিনি।

উপজেলার নালগর গ্রামের বাসিন্দা সফিউল রানা বলেন, ডন্ড কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পালের হাতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। আর এসব প্রতারণার মাধ্যমে সে সহজ-সরল লোকগুলোর কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। এছাড়া এসব লতা-পাতার পচা পানি খেয়ে মানুষ আরো বেশি অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে।

সরেজমিনে রাজার বাজারের চেম্বারে গিয়ে এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভন্ড কবিরাজ দুলাল চন্দ্র পাল প্রথমে বলেন তিনি ঢাকা থেকে এসব ওষুধ আনেন। প্রতিটি ওষুধ ল্যাবে পরীক্ষা করা। এছাড়া সকল কাগজপত্র নিয়েই এই ব্যবসা করছেন তিনি। তবে কাগজপত্র দেখতে চাইলে এক পর্যায়ে দোকান বন্ধ করে পালিয়ে যান তিনি। পরে স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যে বাজারের পাশেই ওই কবিরাজের বাড়িতে গিয়ে ড্রামের ভিতরে লতা-পাতার পচা পানি দেখতে পেলে সুর পাল্টান তিনি। পরিবারের লোকজনসহ ওই ভন্ড কবিরাজ এই প্রতিবেদকে ম্যানেজ করার চেষ্টা চালান। এক পর্যায়ে স্থানীয়দের সামনেই তিনিসহ তার পক্ষের লোকেরা এই প্রতিবেদকে বলতে শুরু করেন এই রিপোর্ট না করার জন্য আপনাকে কত টাকা দিতে হবে?

এই বিষয়ে জানতে চাইলে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.মাইনুদ্দিন বলেন, খোঁজ নিয়ে ওই কবিরাজের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা.মো.মুজিবুর রহমান বলেন, যদি ওই কবিরাজ ভেষজ ওষুধের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অপচিকিৎসা দিয়ে থাকে, তাহলে মোবাইকোর্টের মাধ্যমে ওই কবিরাজের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডা.মো.মুজিবুর রহমান বলেন, এসব পচা পানি পান করলে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন জন্ডিস হতে পারে, লিডারের সমস্যা হতে পারে, হোপাটাইটিস হতে পারে, চর্ম রোগসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।

আরো পড়ুন