কী মধু কুমিল্লা চৌয়ারা বাজারে! কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি খুন
কুমিল্লার নগরীর চৌয়ারা এলাকার আশ-পাশে গত কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়দের দাবি, এসব খুনের নেপথ্যের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে শত বছরের প্রাচীন চৌয়ারা বাজারের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার। তবে এর সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও রয়েছে। খুনের ঘটনা ছাড়াও ওই বাজারে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায়ই মারামারি, চাঁদাবাজি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে বলেও জানা গেছে। এসব ঘটনায় সকলের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, চৌয়ারা বাজারে কী মধু আছে! যার কারণে একের পর এক এসব অপরাধমূলক ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে।
সর্বশেষ গত ১১ নভেম্বর আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্ধে চৌয়ারা এলাকায় স্ত্রী-সন্তানের সামনে স্থানীয় যুবলীগ কর্মী জিল্লুর রহমান চৌধুরি ওরফে গোলাম জিলানীকে নৃসংশভাবে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি জিল্লুর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারণও এই চৌয়ারা বাজার ও চৌয়ারা গরু বাজার। জিল্লুর সঙ্গে বাজারটি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিলো স্থানীয় অপর একটি রাজনৈতিক গ্রুপের।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের শামবক্সি (ভল্লবপুর) এলাকায় দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে করে এসে ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। দেলোয়ার কুমিলা দণি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডেরও অন্যতম প্রধান কারণ চৌয়ারা বাজার ও গরু বাজার। ২০১২ সালের ২৫ মে তৎকালীন চৌয়ারা ইউনিয়নের (বর্তমানে কুমিল্লা সিটি) চাষাপাড়া গ্রামের মেজবা উদ্দিনের ছেলে রাসেলকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে একদল সন্ত্রাসীরা। এই খুনের ঘটনারও অন্যতম কারণ এই বাজারে আধিপত্য বিস্তার বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। এছাড়া গত দশ বছরে বাজারকে কেন্দ্র করে আরও বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
চৌয়ারা বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী, স্থানীয় সূূত্র ও সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৫, ২৬ ও ২৭ নম্বর এই তিনটি ওয়ার্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো শত বছরের প্রাচীন চোয়ারা বাজার। বাজারটি ভারতের সীমান্তের খুবই কাছাকাছি। এই বাজারটি ব্যবহার করেই ভারত থেকে বিভিন্ন পণ্য, গরু, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন মালামাল অবৈধভাবে বাংলাদেশে আনেন চোরাকারবারিরা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বাজারটি দিয়েই ভারত থেকে আসা বিভিন্ন মাদকদ্রব দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে। আর চৌয়ারা বাজারের গরু বাজারটি হলো জেলার অনত্যম বড় গরু বাজার। এই বাজারে অবৈধভাবে আসা ভারতের গরু অবাধে বিক্রি হয়। এখান থেকে এসব গরু দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান পাইকররা। আগে সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার এই গরুর হাট বসতো। তবে এখন বৃহস্পতিবারসহ তিন দিনই এখানে গরুর হাট বসছে। এই গরুর বাজার থেকে প্রতি বাজারে লাখ টাকা আয় করেন ইজারাদারসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। বাজারের সিএনজি স্ট্যান্ড থেকেও প্রচুর টাকা চাঁদা তোলে একটি গ্রুপ। এসব কারণেই বাজারটিতে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের।
সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ কর্মী জিল্লুর হত্যা মামলার মামলার প্রধান আসামি নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো.আবুল হাসান ও মামলার দ্বিতীয় আসামি ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সাত্তারসহ তাদের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বাজারটি। জিল্লুর সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি বাজারে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ ছিলো তাদের। এদিকে, এক সময় চৌয়ারা বাজার ও গরু বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিলো ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ারের হাতে। ২০১৭ সালে সাত্তার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসানসহ ওই বাজার দখল নিতে শুরু করেন। এনিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, এ ঘটনা এবং নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে সাত্তার ও তার সহযোগীরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে দেলোয়ারকে ।
চৌয়ারা বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা অহিদুর রহমান বলেন, ওই দুই কাউন্সিলরের লোকজন চাঁদার জন্য আমার দোকানেও হামলা করেছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করাতে তারা উল্টো আমাকে ৪/৫টি মামলায় জড়িয়ে আমার মামলাটি আপোষ করতে বাধ্য করে। তারা ও তাদের লোকেরা বাজারে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সিএনজির চাঁদা উত্তোলন, গরু বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে একের পর হত্যাকা- করছে। আর সম্প্রতি খুন হওয়া জিল্লু তাদের চাঁদাবাজি ও এসব অপকর্মে বাধা দিতো বলেই তাকে খুন করা হয়েছে।
এদিকে, চৌয়ারা গরু বাজারটির ইজারাদার বিএনপি কর্মী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এবং আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর হাসানসহ অনেকে মিলে বাজারের ইজারা নিয়েছি। গত ৭/৮ বছর ধরে বাজারটি আমরাই পরিচালনা করছি। আর এখন ভারতের গরু আসে না, আগে আসতো। তবে বাজারটি থেকে এখন প্রতি হাটে ৩০/৪০ হাজার টাকার মতো আসে।
এদিকে, এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে কাউন্সিলর আবদুস সাত্তার ও আবুল হাসানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিল্লুর হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তারা এলাকা থেকে পালিয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, জিল্লুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রাজনৈতিক ও নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে। আমার কাছে মনে হয় না চৌয়ারা বাজার দখল নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয় থাকে। আমরা এসব নিয়ে তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে এসবের বিস্তারিত জানানো হবে।
সূত্রঃ barta24