অবশেষে গ্রেপ্তার কুমিল্লার সেই প্রতারক চেয়ারম্যান

এইচএসসি পাস কুমিল্লা জেলার মেঘনার মানিকাচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। জীবনের প্রথমে জীবিকার সন্ধ্যানে রেন্ট-এ-কারে গাড়ি চালাতেন। পরে এখান থেকেই প্রতারণার করার বিষয়টি মাথায় আসে তার। কয়েক বছরের মধ্যে যেন ‘আঙ্গুল ফলে কলা গাছ’। প্রতারণার টাকায় নজর কাড়েন এলাকাবাসীর। পরে সরকার দলের ‘হাইব্রিড নেতা’ জাকির উপর পর্যায়ের এক নেতাকে প্রাডো গাড়ি উপহার দিয়ে লুপে নেন চেয়ারম্যান নমিনেশন।

চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের গাড়ি ব্যবসার ফাঁদে পা দিয়ে দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন এমপি-পুলিশসহ তিন শতাধিক মানুষ। তবে বিদেশে পাচার করার তথ্য এখনও না পেলেও, এই টাকা দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে মেঘনার মানিকাচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নমিনেশন। অনেক নেতার হয়েছেন আস্থাভাজন। প্রতারণার এই টাকা দিয়ে জাকির কিনেছেন গাড়ি। আর কুমিল্লা ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন বাড়ি প্লট ও ফ্ল্যাট, ছেলেকে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

গত বুধবার কুমিল্লা মেঘনা থানা এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে মানিকাচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতারক জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ। এ সময় তার কাছ থেকে দুটি মাইক্রোবাস উদ্ধার করা হয়েছে।

শুক্রবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

ডিবি প্রধান বলেন, জাকির চেয়ারম্যান মূলত কয়েক ধাপে প্রতারণা করেছেন। অন্য কেউ গাড়ি কিনে মাসিক চুক্তিতে তাকে দিত রেন্ট-এ-কার ব্যবসার জন্য। জাকির সেই গাড়ি বিক্রি করে দিতেন, যিনি গাড়ি দিয়েছিলেন তাকে মাসিক চুক্তির টাকাও দিতেন না। আবার স্বল্প মূল্যে গাড়ির মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়েও হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা।

জাকির চেয়ারম্যানের প্রতারণার বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান হারুন-অর-রশিদ বলেন, রেন্ট-এ-কারের ব্যবসার আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন তিনি। তিনি দুই তিন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কাউকে স্বল্প দামে গাড়ি কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি, কাউকে রেন্ট-এ-কারে অধিক মুনাফার কথা বলে টাকা নিয়েছে। সাধারণ মানুষ ছাড়াও জাকির হোসেনের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন সংসদ সদস্য, পুলিশ সদস্যও। অবশ্য প্রভাবশালী এই ব্যক্তিদের মাসিক চুক্তির টাকা পরিশোধ করেছেন জাকির।

হারুন অর রশিদ বলেন, গত কয়েকদিনে ডিবি অফিসে দুই শতাধিক ভুক্তভোগী ভিড় করেছেন। আমরা তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলাম, শুধু মুন্সীগঞ্জের একটি গ্রাম থেকেই ১৫০ জনের কাছ থেকে গাড়ি কেনার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক জাকির। সেই টাকা নেওয়ার পরে ঢাকার নতুন গাড়ির শোরুমে এনে দেখাতেন এটা ভুক্তভোগীদের গাড়ি। পরেই আবার রেন্ট-এ-কারে গাড়ি চালানোর কথা বলে নিয়ে নিতেন সেই গাড়ি।

ডিবি প্রধান হারুন বলেন, পরে কোনো ভুক্তভোগী গাড়ি দেখতে চাইলে তার যেই ২০ থেকে ২৫টি গাড়ি রয়েছে। সেসব গাড়ি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সবাইকে দেখাতেন। তিনি কয়েকজন এমপি, প্রশাসনের লোকদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন। তবে তাদের কাছে ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য মাসিক কিস্তির টাকা মাসে মাসে পরিশোধ করেতেন। এতে করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার প্রতারণা করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।

এর আগেও তাকে গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, সে সময় অনেকে বলেছেন, তিনি গ্রেপ্তার হলে মাসিক কিস্তির টাকা পাবেন না। তিনি বেশির ভাগেরই মাসিক কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন নি। মূল টাকা তো নেই, গাড়িও মেরে দিয়েছেন। পরে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তিতে ও মুগদা থানায় এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা (তেজগাঁও) বিভাগ জাকির চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

হারুন-অর-রশিদ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি প্রতারণায় টাকায় তিনি গ্রামের বাড়িতে আলিসান বাড়ি করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে কাউকে প্রাডো গাড়ি কিনে দিয়েছেন, নির্বাচনে বিপুল টাকা খরচ করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। ঢাকা শহরে তিনি একাধিক গাড়ি-ফ্ল্যাট-প্লট করেছেন। প্রতারণার টাকায় তিনি নিজের ছেলেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। আগামী নভেম্বরে তারও যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই ডিবি তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব।

এছাড়া ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরতের চেষ্টা করা হবে। তার সম্পদ জব্দের জন্য প্রয়োজনে সিআইডিতে মামলা হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

ডিএমপি ডিবি প্রধান বলেন, জাকির চেয়ারম্যান পোর্ট থেকে স্বল্প দামে গাড়ি কিনে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেন। গাড়ি রেন্ট-এ-কারের মাধ্যমে মাসিক ভাড়ায় পরিচালনা করার জন্য চুক্তি করেন। একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরের গাড়ি একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করেন। এছাড়াও পূর্বের বিক্রয়কৃত গাড়ি স্বল্প মূল্যে মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

চেয়ারম্যান জাকিরের প্রতারণার শিকারে নিঃস্ব তারা:

গাড়িচালক থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনে যাওয়া জাকিরের প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব প্রায় মুন্সীগঞ্জের সায়েম শেখ। নিজের সংসার ব্যয় নির্বাহের এক মাত্র দোকান বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা জাকিরের হাতে তুলে দেন সায়েম। গাড়ির শো-রুম নিয়ে গিয়ে তাকে দেখানো হয়েছিল এটা তার গাড়ি। পরে চুক্তি হয় এই গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে মাসিক ৭০ হাজার টাকা দেবেন জাকিরকে।

কিন্তু প্রথম মাসের ভাড়া দিয়ে সায়েমকে আর কোনো টাকা দেননি জাকির। শেষ পর্যন্ত নিজের গাড়িও ফেরত পাননি সায়েম। সায়েম গণমাধ্যমকে বলেন, এক বছর ভাড়া দেয়নি। টাকার জন্য চাপ দিলে সাড়ে সাত লাখ টাকার একটা চেক ধরিয়ে দেয়। বাকি টাকা চাইলে মামলা-হামলার হুমকি দেয়। একই গাড়ি প্রতারক জাকির ২৫ জনের কাছে বিক্রি করেছে উল্লেখ করে সায়েম বলেন, পুলিশ প্রশাসন ও কয়েকজন সংসদ সদস্যও এই জাকির চেয়ারম্যানের ক্লায়েন্ট। তাদের দেখেই আমরা সাধারণ মানুষ রেন্ট-এ-কার ব্যবসার জন্য তার কাছে টাকা দেয়।

সায়েমের মতো প্রতারণার শিকার মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি এলাকার সোহেল মোল্লা। তিনি বলেন, পুলিশের অনেক এসআই, ওসি দেখে আমি আস্থা পাই। বেশি মুনাফার লোভে সেখানে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দুটি গাড়ি কিনি। গাড়ি কেনার পর কয়েক দফায় সাড়ে সাত লাখ টাকা আমি পেয়েছি। বাকি টাকা আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে আর দেয়নি।

প্রতারণার শিকার আরেক ভুক্তভোগী রাজধানীর চাঁদনি চকে থ্রি পিসের ব্যবসায়ী মাসুম মোল্লা। তিনি বলেন, আমি ব্যভসার পাশাপাশি ১৫ লাখ টাকায় একটা হায়েস গাড়ি কিনে রেন্ট এ কারের ব্যবসায় মাসিক ৭০ হাজার টাকায় চুক্তি করি। এক বছরে মাত্র এক মাসের টাকা দিয়েছে। এরপর টাকাও নেই, গাড়িও নেই।

সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিবি গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) গোলাম সবুর, অতিরিক্ত উপকমিশনার শফিকুল ইসলাম, তেজগাঁও জোনাল টিম লিডার অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা ও অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) হাফিজ আল আসাদ উপস্থিত ছিলেন।

আরো পড়ুন