এমপি-চেয়ারম্যান দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত কুমিল্লার দেবীদ্বার
কুমিল্লার দেবীদ্বারে সংসদ সদস্য (এমপি) রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদের মধ্যে বনিবনা নেই। রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে এখানে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা দুই নেতার পক্ষ নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এমপি-চেয়ারম্যান অনুসারীদের মাঝে দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। খোদ এমপির ঘুসিতে উপজেলা চেয়ারম্যান আহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
সর্বশেষ গত ৩ অক্টোবর রাতে উপজেলার ভিংলাবাড়ী এলাকায় পূজামণ্ডপ পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়িবহরে হামলা, ভাঙচুর ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অর্ধশতাধিক জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। নেতাকর্মীতে এমন দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল পর্যায়েও। এজন্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে দুষছেন। এ অবস্থায় ধাওয়া-পালটা ধাওয়াসহ হামলা-মামলার কারণে দলীয় অঙ্গনে বাড়ছে উত্তাপ। দলের হাইকমান্ড এখনই উদ্যোগ নিয়ে এ অবস্থার সুরাহা না করলে এখানে যে কোনো সময় দুইপক্ষে বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামী লীগে দীর্ঘ বছর ধরে নেতা-নেতৃত্বে দ্বিধাবিভক্তি চলে আসছে। সাংগঠনিক কমিটি গঠন এবং জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী মনোনয়নে এ বিরোধ সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এ বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। ঐ নির্বাচনে দলের মনোনয়নে মো. আবুল কালাম আজাদ দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। রাজনীতির মাঠে তার পক্ষের নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় এমপি পক্ষের বিরোধ দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে উভয়ের পক্ষের প্রার্থী মনোনয়নের প্রতিযোগিতা নিয়েও দলের তৃণমূলে বিভাজন প্রকট হয়ে ওঠে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ ২৬ বছর পর দেবীদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আয়োজন উপলক্ষ্যে গত ১৬ জুলাই বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকে দলের উপজেলার কাউন্সিলের আগে ইউনিয়নের কাউন্সিল করা নিয়ে প্রথমে বাগিবতণ্ডা, হাতাহাতি ও মারধরের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে এমপির এলোপাতাড়ি ঘুসিতে উপজেলা চেয়ারম্যান কানে-মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আহত হন, মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এ ঘটনার খবরে তাত্ক্ষণিকভাবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দেবীদ্বারে, ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। বিক্ষোভ, সমাবেশ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাধাইয়া এলাকায় অবরোধ করে চেয়ারম্যান পক্ষ এমপির বিচার দাবি করলে সেখানে হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেরে দেবীদ্বার সদরেও দুই পক্ষে ঘটে হামলা-পালটা হামলার ঘটনা। ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দেবীদ্বার। এ অবস্থায় ঐ সময় সম্মেলন স্থগিত করা হয়।
জানা যায়, ঐ ঘটনার পর দুই নেতার মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে গত ২ সেপ্টেম্বর দেবীদ্বার উপজেলা সদরের এ বি এম গোলাম মোস্তফা স্টেডিয়ামে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। ঐ সম্মেলনে এ কে এম সফি উদ্দিন সফিককে সভাপতি, মোস্তফা কামাল চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক ও হুমায়ুন কবিরকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে উপজেলা আওয়ামী লীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ।
স্থানীয় একাধিক নেতা জানান, এমপির কিল-ঘুসিতে উপজেলা চেয়ারম্যান আহত হওয়ার ঘটনাটি দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এ ঘটনায় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বৈঠক করে দুই নেতার বিরোধের বিষয়টি নিষ্পত্তি করলেও সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। সর্বশেষ উপজেলা চেয়ারম্যানের সরকারি গাড়িতে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। হামলায় পাঁচ জন আহত হন। এ ঘটনার জন্য স্থানীয় এমপি অনুসারী নেতাকর্মীদের দায়ী করেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থানীয় একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তাদের হামলা-মামলা ও নির্যাতনের ভয়ে তটস্থ থাকতাম, রাতে ঘুমাতে পারতাম না। এখন নিজ দলের নেতাকর্মীদের সংঘাত-সংঘর্ষ আর হামলা-মামলার ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। আরেক নেতা বলেন, এখানে কেউ কারও কমান্ড মানতে চান না। মাঠপর্যায়ে যারা সংঘাতের পথ বেছে নেবেন, তাদের দায়িত্ব সংগঠন নেবে না, তাদেরই নিতে হবে।
সংঘাত এড়াতে নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার। তিনি বলেন, সবাইকে শান্ত থাকতে হবে এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
দেবীদ্বার থানার ওসি কমল কৃষ্ণ ধর সাংবাদিকদের বলেন, দুই পক্ষই ক্ষমতাসীন দলের। যে কোনো সময় তারা সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে পুলিশ সতর্ক আছে। থানায় মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে।