এক যুগ পর বাহারের দখল থেকে মুক্ত কুমিল্লার থিয়োসোফিকেল সোসাইটি ভবন
ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বমানবতার কল্যাণে কাজ করা থিয়োসোফিকেল সোসাইটির কার্যক্রম বাংলাদেশে শুরু হলে ১৮৮৯ সালে কুমিল্লা টাউন হল সংলগ্ন এলাকায় একটি ভবন নির্মিত হয়।
ঐতিহ্যবাহী ভবনটিতে সর্বধর্মের জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হতো। কিন্তু এক যুগ আগে ভবনটিতে তালা ঝুলিয়ে ‘জবরদখল’ করেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবিদুর রহমান জাহাঙ্গীর। ফলে বন্ধ হয়ে যায় সোসাইটির কার্যত্রম।
আবিদুর রহমান কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন ও সেনানিবাস এলাকা) আসনের সাবেক সাংসদ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের বিশ্বস্ত সহযোগী।
অভিযোগ আছে, এই ভবনটির জমিতে ১৫তলা বিশিষ্ট মার্কেট করতে চেয়েছিলেন বাহার। তার নির্দেশেই ভবনটি দখল করেন আবিদুর রহমান।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাবেক সংসদ সদস্য বাহার ভারতে পালিয়ে গেছেন আর গত শনিবার গ্রেপ্তার হয়েছেন আবিদুর রহমান। এমন পরিস্থিতিতে থিয়োসোফিকেল সোসাইটি ভবন দখলমুক্ত করেছে সংশ্লিষ্টরা।
কুমিল্লা থিয়োসোফিকেল সোসাইটির সদস্য তাপস কুমার বকসী জানান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ১৮৭৫ সালের ১৭ নভেম্বর সর্বধর্মের জ্ঞানভিত্তিক আলোচনার লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল থিয়োসোফিকেল সোসাইটির।
এই সোসাইটির মূলমন্ত্র হচ্ছে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বমানবতার কল্যাণে কাজ করা। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রসারিত হলে বাংলাদেশেও এর কার্যক্রম শুরু হয়।
১৮৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকার টাউন হল মাঠের পশ্চিম পাশে সোসাইটির জন্য ভবন নির্মিত হয়।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কুমিল্লা জেলা শাখার নবগঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “থিয়োসোফিকেল সোসাইটির ভবনটির দক্ষিণ পাশে এমপি বাহারের টাউন হল সুপার মার্কেট এবং উত্তরে কুমিল্লা মিনিস্ট্রেরিয়াল অফিসার্স ক্লাব। বাহার চেয়েছিলেন পুরো জায়গাটিতে ১৫তলা বিশিষ্ট মার্কেট করতে।
পরে কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের (কুমিল্লা টাউন হল) সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় ২০১২ সালে থিয়োসোফিকেল সোসাইটির ভবনটি জবরদখল করেন আবিদুর রহমান জাহাঙ্গীর।
“আমাদের কাছ থেকে জোর করে এটির চাবি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে আমরা এখানে আসতে পারিনি। সর্বধর্মের জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হওয়াও সম্ভব হয়নি।”
বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ময়লা-আবর্জনায় ভরা থিয়োসোফিকেল সোসাইটির ভবনটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তা তদারকি করছেন তাপস কুমার বকসী
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বেদখল থাকায় ভবনটি নোংরা আবর্জনায় ভরে গেছে। পুরো ভবনটি স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে উৎকট দুর্গন্ধ।
“আমরা এখন এটি পরিষ্কার করছি। এনিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বসবো আমরা।”
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, থিয়োসোফিকেল সোসাইটির কার্যক্রম বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশে পরিচালিত হয়েছে; বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম কুমিল্লাতেই এর কার্যক্রম শুরু হয়। কুমিল্লার অনেক বিশিষ্ট ও গুণীজনরা এটির দায়িত্ব পালন করেছেন।
থিয়োসোফিকেল সোসাইটি ভবন, কুমিল্লা ক্লাব, টাউন হল সুপার মার্কেট, কুমিল্লা মিনিস্ট্রেরিয়াল অফিসার্স ক্লাব- এগুলোর সবই কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন বা কুমিল্লা টাউন হলের সম্পত্তিতে নির্মিত।
১৮৮৫ সালে টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চার বছর পর টাউন হলের জায়গার একটি অংশে থিয়োসোফিকেল সোসাইটিকে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, “থিয়োসোফিকেলসোসাইটি একটি শহরের আভিজাত্য, গৌরব এবং সমৃদ্ধির চিহ্ন বহন করে। যুক্তরাষ্ট্রের পর এটির কার্যক্রম ছিল মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) এবং এর পরেই কুমিল্লায়।
“এখানে সর্বধর্মের জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হতো। যতদিন পণ্ডিত রাসমোহন চক্রবর্তী জীবিত ছিলেন- ততদিন পর্যন্ত শহরের জ্ঞানী মানুষদের নিয়ে প্রত্যেক সোমবার এখানে জ্ঞানভিত্তিক আলোচনার আসর বসতো।
“রাসমোহন চক্রবর্তী ১৯৮২ সালে মারা গেছেন। এমন একটি প্রতিষ্ঠান বিগত সময়ে জবরদখল হয়ে যাওয়া সত্যিই দুঃখজনক বিষয়।”
কুমিল্লা থিয়োসোফিকেল সোসাইটির সভাপতি ও লালমাই সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বলেন, “কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দীনের লোকেরা এটিকে তাদের দখলে রেখেছিলেন। এজন্য বিগত সময়ে এখানে কোনো কার্যক্রম ছিল না। এখন থিয়োসোফিকেল সোসাইটি জবরদখল মুক্ত।
“আমরা অচিরেই এখানে কার্যক্রম শুরু করব। আমাদের মূলমন্ত্র হলো- যে যেই ধর্মেরই হোক না কেন সকলে মিলে বিশ্বমানবতার কল্যাণে কাজ করা। ”