সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকও ভু য়া মুক্তিযোদ্ধা

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের তিন মেয়াদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে ‘ভুয়া সনদ বাণিজ্য’ করার অভিযোগ উঠেছে। কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এক থেকে দুই কোটি টাকার বিনিময়ে ভুয়া সনদ দিয়েছেন। এভাবে তিনি প্রায় ২৫ হাজার ভুয়া সনদ বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন-এমন অভিযোগ ’৭১-এর সম্মুখসারির একাধিক যোদ্ধার। তাদের মতে, শুধু ভুয়া সনদ বিক্রি করেই ক্ষান্ত হননি, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ‘টেম্পারিং’ করে সনদ নিয়েছেন নিজেও। এ ব্যাপারে প্রায় দেড় বছর আগে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন করা হয়। ইতোমধ্যেই প্রাথমিক শুনানি শেষ হয়েছে। শিগগিরই চূড়ান্ত শুনানি হবে।
জানা গেছে, আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যুদ্ধ করেছেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এ নিয়ে তিনি নিজেও খুব বেশি বর্ণনা করেননি। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক সিনিয়র মন্ত্রী হওয়ায় এতদিন কেউ মুখ খোলেননি। তবে বিতর্কটি শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা গেজেট প্রকাশ করে। সেখানে আ.ক.ম মোজাম্মেলের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয় খোদ জাতীয় সংসদেও। এ নিয়ে ২০২৩ সালে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)-এর সদস্য ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের মহাসচিব খ.ম. আমীর আলী। মামলা নং ১৫১৪২। রিট মামলায় মোট সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন-তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (সাবেক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট এবং প্রত্যয়ন শাখার যুগ্মসচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, ঢাকা জেলা প্রশাসক এবং মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য সচিব। তবে তারা সবাই জবাব না দিয়ে সময় নিয়েছেন আইনজীবীর মাধ্যমে।
জানা যায়, ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ৫১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম নেই আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের। জাতীয় জাদুঘরে রাখা ১৯৮৬ সালে তৈরিকৃত লাল মুক্তিবার্তার ভলিউম ঘষামাজা করে নাম অন্তর্ভুক্তি করার অভিযোগ রয়েছে। তবে অ্যাডভোকেট হামিদের লেখা ‘জিন্দাবাদ থেকে জয় বাংলা’ বইয়ের ৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক উল্লেখ করেছেন, তিনি ডেপুটি চিফ পদে ভারতের ত্রিপুরার গোকুলনগর ক্যাম্পের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। এদিকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মুদ্রিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’র ৩য় খণ্ডের ৬২০ ও ৬২১ পৃষ্ঠায় গোকুলনগর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শিবিরের কথা বলা হয়েছে। সেখানে ক্যাম্পে ডেপুটি চিফ পদ ও আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে ২১ নম্বর সিরিয়ালে ক্যাম্প চিফ হিসাবে শামসুল হক এমপি ও ওয়াসিউদ্দিনের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা বালাম বইয়ের কয়েকটি পাতার ফটোকপি মামলার নথিতে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখানে আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের নাম রয়েছে। ওই পাতায় সব লেখা সবুজ রঙের। তবে মোজাম্মেলের নামের পাশে কয়েক জায়গায় ঘষামাজা ও কালো রঙের কালিতে লেখা হয়েছে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেন, সাবেক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে ও জামুকায় পৃথক অভিযোগ জমা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন ডকুমেন্টস উপস্থাপন করা হয়েছে। আদালতে বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়েছে। চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। আমরাও সেই আদেশের অপেক্ষা করছি। পাশাপাশি অন্য যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছে, তা চিহ্নিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)-এর মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিষয়ে অভিযোগ আছে। আমরা একটি শুনানির মাধ্যমে চূড়ান্ত করব। খুব শিগগিরই এটা করা হবে।
আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক ১৯৭৬ সাল থেকে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। টানা তিন মেয়াদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। এলাকায় তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, দলে গ্রুপিং তৈরি করে অন্য নেতাদের দমন, নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আ.ক.ম. মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও রয়েছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো তিনিও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়, এরপর টেক্সট করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।