দখলে দূষণে মৃতপ্রায় কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদী

ডেস্ক রিপোর্টঃ ডাকাতিয়া একসময় দক্ষিণ কুমিল্লাসহ চাঁদপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলার মানুষের কাছে ছিল আশীর্বাদ, প্রাণের স্পন্দন। নদীটির নাম ডাকাতিয়া কেন, এই নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহলের শেষ ছিল না। ইতিহাস বলছে, নদীটির নামকরণের পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। একসময় ডাকাতিয়া নদী তীব্র খরস্রোতা ছিল। মেঘনার এই উপনদীটি মেঘনার মতোই উত্তাল ছিল। ফলে ডাকাতিয়ার করাল গ্রাসে নদীর দুই পারের মানুষ সর্বস্ব হারাত। জীবন বাঁচাতে ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের সলিলসমাধি রচিত হয়েছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী বলে এর নামকরণ হয়েছে ‘ডাকাতিয়া’ নদী। সেই ডাকাতিয়া এখন দখল-দূষণে, নাব্যতা হারিয়ে রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে। লাখো মানুষের প্রাণের স্পন্দন হিসেবে পরিচিত নদীটি এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে।

ডাকাতিয়ায় একসময় পাল তোলা নৌকা চলত। নদীটি ছিল বড় বড় লঞ্চ ও মালবাহী ট্রলারের রুট। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা ফসল আবাদের সময় এ নদী থেকে পেত পর্যাপ্ত পানি। ছিল দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। ডাকাতিয়া নদী ছিল এ অঞ্চলের বহু মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। দক্ষিণ কুমিল্লাসহ চাঁদপুরের মানুষের কাছে ডাকাতিয়া নদী আশীর্বাদের হলেও বর্তমানে নদীটি অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, সদর দক্ষিণ, লালমাই, লাকসাম ও  মনোহরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীর দুই পার অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দখলে এগিয়ে রয়েছে এলাকার প্রভাবশালীরা। বিভিন্ন স্থানে কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলে বিষাক্ত করে তোলা হয়েছে নদীটিকে। এ ছাড়া যুগ যুগ ধরে খনন না করায় পলি জমে ভরাট হয়ে নদীটি নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই ভেসে যায় নদীর দুই কূল। সেচের সময় বা বোরো মৌসুমে ডাকাতিয়া হয়ে উঠে ধু ধু বালুচর। বর্ষা মৌসুমে নদীটি হয়ে ওঠে দক্ষিণ কুমিল্লাসহ আশপাশের এলাকার বন্যার প্রধান কারণ। ওই সময় নদীটির পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করে বন্যায় ভাসিয়ে দেয় শত শত গ্রাম।

ছবি সূত্রঃ ইত্তেফাক

নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার চৌদ্দগ্রাম, সদর দক্ষিণ, লালমাই, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, চাঁদপুরের শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া। বর্তমানে নদীটি দখল-দূষণ এবং ভরাটের ফলে নদীর তলদেশে মাইলের পর মাইল বালুচর জেগে নাব্যতা হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শুকনো মৌসুমে এখন আর নদীটিতে পানি থাকে না। যেসব উপজেলার হাট-বাজার ও জনবসতি ঘেষে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে সেসব এলাকায় চলছে দখলের পর অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা।

চৌদ্দগ্রাাম উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে, সদর দক্ষিণের শুয়াগাজীর পাশে, লালমাই উপজেলার বাগমারা এলাকায়, লাকসামে পৌর শহরের দৌলতগঞ্জ বাজারের রাজঘাট, গোলবাজার, সামনীরপুল, পশ্চিমগাঁও, সিংজোড়, শ্রীয়াং, হামিরাবাগ, কালিয়াপুর, মনোহরগঞ্জ উপজেলা সদরের মনোহরগঞ্জ বাজার, ঝলম, হাটিরপাড়, দিশাবন্দ, আমতলী, চিতোশীসহ বিভিন্ন স্থানে ডাকাতিয়ার দুই তীরে দখলদাররা অবৈধভাবে ভবন, মার্কেট ও স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এতে নদীটির অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে। স্থানীয়রা নদীটি দখল মুক্ত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়েছে।

ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ডাকাতিয়া নদী বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্ত সীমান্ত নদী। এটি মেঘনার উপনদী হিসেবেও পরিচিত। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা কাঁকড়ী নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের কাশিপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর চৌদ্দগ্রাম হয়ে হাজীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ২০৭ কিলোমিটার। প্রস্থ ৬৭ মিটার (প্রায় ২২০ ফুট)। নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডর। এদিকে নদীটির নামকরণ নিয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে, সম্ভবত এই নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করত এবং নদীতে এরা ডাকাতি করত। ডাকাতের উত্পাতের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

২০৭ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির কোথাও বর্তমানে ২২০ ফুট প্রস্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। দখল হতে হতে নদীটি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে বললেই হয়। ২২০ ফুটের নদীটি কোথাও ৩০, কোথাও বা ৪০ ফুটের মরা খালে পরিণত হয়েছে।

ছবি সূত্রঃ এস এ টিভি

লাকসামের প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল জলিল বলেন, একসময় এই অঞ্চলের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নৌপথ। ডাকাতিয়া নদীর বদৌলতে ওই সময় লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। আর ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যমও ছিল নৌপথ। ওই সময় বিভিন্ন পণ্যবাহী বড় বড় জাহাজ ও লঞ্চ এই নদীপথ দিয়ে চলাচল করত। নৌ যোগাযোগের সুবিধার কারণে এই নদীপথে শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার লোকজন লাকসামে এসে বাণিজ্য করত। এ ছাড়া আগে খরস্রোত এই নদীতে ছিল দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। কয়েক হাজার জেলে এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে প্রভাবশালীরা নদীটি দখল করে নিচ্ছে। এ বিষয়ে দ্রুত কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। না হয় একসময় ডাকাতিয়া নদীর অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

জেলার দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি উপজেলার অন্তত ১০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে ডাকাতিয়া নদীর পানি দিয়ে হাজার হাজার একর জমিতে কৃষি আবাদ হতো। বর্তমানে ইরি-বোরো আবাদের মৌসুমে ডাকাতিয়া ও এর শাখা খালগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। পানির অভাবে  বেশির ভাগ জমি ফেটে যায়। অবিলম্বে দখলের কবল থেকে নদীটিকে মুক্ত জরুরি ভিত্তিতে খনন প্রয়োজন। তাহলে এসব অঞ্চলের কৃষকরা আবারও আগের মতো ফসল উত্পাদন করতে পারবে।

মনোহরগঞ্জের কেয়ারি গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ আলম বলেন, বিভিন্ন সময় এলাকার প্রভাবশালীরা নদীদখল আর দূষণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যে ডাকাতিয়া একসময় দক্ষিণ কুমিল্লার মানুষের জন্য আশীর্বাদ ছিল, এখন তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু ডাকাতিয়া নদী নয়, প্রায় সব নদী, শাখা নদী ও খালগুলো রক্ষায় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নদী-খাল দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এসব বন্ধ করতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ বি এম খান মোজাহেদী জানান, ডাকাতিয়া নদীর মধ্যে বিশেষ করে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার অংশে দখলের কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ডাকাতিয়া নদীখননের বিষয়েও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ

আরো পড়ুন