বর্জ্য প্লাস্টিক পুন:প্রক্রিয়াজাত করণে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার আঞ্চলিক কেন্দ্র
ডেস্ক রিপোর্টঃ আমেরিকা প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. মইন উদ্দিন সরকার জানান, বাংলাদেশকে এশিয়ার বর্জ্য প্লাস্টিক পুন:প্রক্রিয়াজাত করণের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে দেশের আলাদা একটি জায়গা করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার আঞ্চলিক কেন্দ্র বা এশিয়ার হাব।
সোমবার (৮ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন বিজ্ঞানী ড. মইন উদ্দিন সরকার এ কথা বলেন। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন ড. আনজুমান সেলী, নাসির উদ্দিন তন্ময় প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে ড. মইন উদ্দিন সরকার বলেন, যখন সারা দুনিয়ায় দিনে দিনে বাড়ছে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার, সেই সঙ্গে আমাদের চারপাশে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্য। যা হয়ে ওঠেছে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশির জন্য মারাত্মক হুমকি। প্লাস্টিক পচনশীল নয়, বিধায় মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরা শক্তি। খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে। ড্রেনের পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা বিঘিœত হচ্ছে, ফলে মশা-মাছির প্রকোপ বেড়েই যাচ্ছে এবং বৃষ্টি হলে শহরে নৌকা চালাতে হচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিন-এর প্রাদুর্ভাবে বন ও জলজ জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। শুধু আমেরিকাতেই প্রতি বছর ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড প্লাস্টিক উৎপাদন হয়, যার মাত্র ৬% অর্থাৎ ৪.৮ বিলিয়ন পাউন্ড পুন:প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
আমাদের জানা মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৮ মিলিয়ন মেট্রিকটন ‘মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়্যাস্ট (এমএসডব্লিউ)’ বর্জ্য উৎপাদন হয়, যার মধ্যে ১৫% ই প্লাস্টিক অর্থাৎ ৪.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। যার মাত্র ১০% পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব হয়। ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারাবিশ্বে প্রায় ৬.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছে, যার মাত্র ৯% পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ সক্ষম হয়েছে। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। যার প্রেক্ষিতে প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। এই সমস্যা সমাধান নিয়ে চিন্তিত পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তারা প্লাস্টিকের আগ্রাসন থেকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে রক্ষার জন্য দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছেন নানা অনুসন্ধান।
এই অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ হয়েই বর্জ্য প্লাস্টিকের সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০৫ সাল থেকে আমি ও আমার সহকর্মী ড. আনজুমান সেলী গবেষণা কাজ শুরু করি এবং ২০১০ সালে প্লাস্টিক থেকে তেল উৎপাদনের একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার পেটেন্ট করি। যা নবায়নযোগ্য শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রায় দুই দশক গবেষণার পর আমরা সাফল্যের সাথে একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হই।
যে প্রযুক্তিটি হতে প্রতি টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে ১৩০০ লিটার জ্বালানী তেল, ১০ সিলিন্ডার এল.পি.জি গ্যাস এবং ২৩ লিটার জেট (এভিয়েশন) ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এরপর নিজেদের গবেষণার সাফল্যেকে বাস্তব রূপ দিতে আমরা নিজেরাই আমেরিকায় প্লান্ট অর্থাৎ পরিত্যাক্ত প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছি। আমাদের উৎপাদন কোম্পানিটির নাম ডধংঃব ঞবপযহড়ষড়মরবং খখঈ,আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র। এই কোম্পানিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে তেল তৈরির কাজসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করছে ।
আমরা যেহেতু বাংলাদেশি- জন্মভূমির মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বর্তমানে ও কোম্পানিটি বাংলাদেশেও এ রকমের প্ল্যান্ট করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই প্ল্যান্ট কেন্দ্র স্থাপন হলে একাধারে যেমন দেশকে ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, তেমনি দেশের স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। দেশ অর্জন করতে পারবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশকে এশিয়ার বর্জ্য প্লাস্টিক পুন:প্রক্রিয়াজাত করণের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে দেশের আলাদা একটি জায়গা করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার আঞ্চলিক কেন্দ্র বা এশিয়ার হাব। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে পুনঃব্যবহার বা রিসাইক্লেনিংয়ের জন্য বর্জ্য সংগ্রহ করার ফলে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে তেমনি প্রয়োজনীয় জ্বালানি উৎপাদন করা যাবে। নিশ্চিত হবে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা।
এ ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা গেলে মানুষের প্রয়োজনীয় গ্রিন টেকনোলজির চাহিদাও পূরণ হবে। দিন দিন আমাদের এই প্ল্যান্ট পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃৃত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এ রকমের প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে দেশের পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনীতির উন্নয়ন করে দেশকে জ্বালানী উৎপাদনে সহায়তা করা সম্ভব হবে। আমাদের ইচ্ছা এই প্রযুক্তির সুফল বাংলাদেশের মানুষ ভোগ করুক। তাই এই কাজে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা কামনা করছি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের অবস্থান থেকে এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি স্বার্থ নেই। এ দেশ ও মাটির সন্তান হিসাবে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এখানকার মানুষের জন্য কিছু করার লক্ষ্যেই আমাদের এই ফিরে আসা। দেশের প্রতি ভালোবাসার তাগিদে, নিজেদের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ব থেকেই জন্মভূমিকে ক্ষতিকারক প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত করে দেশের পরিবেশ উন্নয়ন, স্বল্পশিক্ষিত থেকে সুশিক্ষিত যুবকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনীতির স্বচ্ছলতায় অবদান রাখাই আমাদের ইচ্ছা। আমরা আশা করি, এই প্রযুক্তিটি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশবাসী এর সুফল ভোগ করবেন এবং বাংলাদেশকে একটি সবুজ সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞানী ড. মইন উদ্দিন সরকার এই বাংলার কাদা মাটিরই সন্তান। তিনি ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এম.এস.সি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে (ইউকে) গমন করেন। ১৯৯৬ সালে লন্ডনের ম্যানচেস্টার ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দীর্ঘ ২৮ বছর যাবত গবেষক হিসেবে বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, তাইওয়ান, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস অন্যতম।