দল বেঁধে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিন: কুমিল্লায় মির্জা ফখরুল
ডেস্ক রিপোর্টঃ ভোটের দিন দল বেঁধে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বুধবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে কুমিল্লার চান্দিনায় ড. রেদোয়ান আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠে এক নির্বাচনী সভায় বিএনপি মহাসচিব স্থানীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের প্রতি এ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আপনাদের একটি ভোট দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আসবে, দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে। ৩০ ডিসেম্বর আপনারা দল বেঁধে ভোট কেন্দ্রে যাবেন, ভোট দেবেন এবং ভোট গণনা শেষে না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র ছাড়বেন না। ভোট কেন্দ্র পাহারা দেবেন।’
কুমিল্লা-৭ আসনে (চান্দিনা) ধানের শীষের প্রার্থী রেদোয়ান আহমদকে ভোট দেয়ার জন্য এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই কমিশনের একজন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্ল্যায়িং ফিল্ড নেই। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন- ‘না না সব ঠিক আছে’।’ এসময় উপস্থিত নেতাকর্মীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে শ্লোগান দিতে থাকে।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে ফখরুল বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ভুয়া, সরকার ভুয়া। তারা একসঙ্গে মিলে গণতন্ত্রকে জবাই করছে। আমরা বলতে চাই, জনগণ এবার আর তা মেনে নেবে না।’
মির্জা ফখরুল অভিযোগ করে বলেন, ‘এ নির্বাচনে কোনও নিরপেক্ষতা নেই। এখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনও পরিবেশ নেই। নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হতে যাচ্ছে। দেশের মানুষ এসব বুঝে। আমি বলতে চাই, জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্ঠায় সরকারের সব ষড়যন্ত্র ও কলাকৌশল ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সরকার ‘অন্যায়ভাবে’ কারাগারে আটকে রেখেছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন, নারীশিক্ষা, কৃষিখাত, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবাসহ বিএনপির ঘোষিত ইশতেহারের নানা দিক তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি শান্তিময় ও সৌহার্দপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি চাই না।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘শুধু তাই নয়, আমরা ক্ষমতায় গেলে সকল মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করবো। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের কথা বলেছি। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, তারা দাঁড়ি রাখেন। এখন দাঁড়ি রাখলে জঙ্গি বলা হয়। অথচ দাঁড়ি রাখা আমাদের কৃষ্টি ও ঐহিত্য।’
সভার শেষ দিকে কুমিল্লা-৭ আসনে রেদোয়ান আহমেদ ও কুমিল্লা-৩ আসনে কাজী মুজিবুল হকের হাতে ধানের শীষ তুলে দেন ফখরুল।
এর আগে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে সকাল ১০টায় সড়কপথে চান্দিনা ও সোয়াগাজী দুটি নির্বাচনী সভায় যোগ দিতে রওনা হন বিএনপি মহাসচিব।
চান্দিনার আগে দাউদকান্দি বাসস্ট্যান্ডের সামনে কুমিল্লা-১ ও কুমিল্লা-২ আসনে দলের প্রার্থী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতাকর্মীরা সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দেন। এসময় নেতাকর্মীদের হাতে ধানের ছড়া ও খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ছিলো।
খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে ব্যারিস্টার খন্দকার মারুফ হোসেন বিএনপি মহাসচিবকে অভ্যর্থনা জানান। সেখানে হ্যান্ড মাইকে মির্জা ফখরুল সকলকে ৩০ ডিসেম্বর ধানের শীষের প্রার্থী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। এছাড়া কুমিল্লার মিয়াবাজারের সড়কে কুমিল্লার মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর নেতৃত্বে জেলা নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা বিএনপি মহাসচিবকে করতালি দিয়ে স্বাগত জানায়।
সুয়াগাজীতে নির্বাচনী সভায় ফখরুল:
মনিরুল হক চৌধুরীর পক্ষে ভোট চাইতে গিয়ে আবারও কাঁদলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিকেলে কুমিল্লার সোয়াগাজী পুরাতন হেলিপ্যাড মাঠে এক নির্বাচনী সভায় বিএনপি মহাসচিব ভোট চাইতে গিয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন। মনিরুল হক চৌধুরীর মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসকে পাশে রেখে এরকম পরিস্থিতিতে পুরো মাঠের নেতাকর্মীদের অনেকে কাঁদতে দেখা যায়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই যে আমার মেয়ে শাম্মী। এতো কথা বলেছে কার জন্যে? তার তো আজকে জনসভায় কথা বলার কথা নয়। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। তার গবেষণা করার কথা, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর কথা। অথচ আজ সে বাবার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে।’
‘‘আমি আজকে আপনাদের সকলের কাছে একটা করে ভোট ভিক্ষা চাইব। আমার হৃদয়ের বন্ধু মনিরুল হক চৌধুরী মুক্তির জন্য একটা ভোট ভিক্ষা চাচ্ছি, আমি একটা ভোট ভিক্ষা চাচ্ছি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য, আমি ভোট চাচ্ছি কারাবন্দি নেতা গফুর ভুঁইয়া ও মোবাশ্বের আলী ভুঁইয়ার মুক্তির জন্য”- যোগ করেন তিনি।
অশ্রুসজল কণ্ঠে ফখরুল বলেন, ‘আপনাদের যে ভাইয়েরা এখানে সামনে যে ছোট ছোট ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে অনেকে ঢাকায় রিকসা চালায়। এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারা পালিয়ে থাকে, হকারি করে। এটা কি আমাদের স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা, এটা কি স্বপ্নপূরণের নমুনা? আমাদের স্বাধীনতার সমস্ত স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে এই আওয়ামী লীগ সরকার।’
কুমিল্লা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামালের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তিনি নাকি হুমকি দিয়ে বলেন এখানে (নাঙ্গলকোর্ট, কুমিল্লা-১০) ২৭ তারিখ থেকে আর কোনও বিএনপি থাকবে না। আমি বলি আপনি কে? আপনি কি জমিদার? আপনি কি রাজা? এই কথা বলার আপনি কে?’
ফখরুল বলেন, ‘এই মাটি আমাদের, এই দেশ আমাদের। এখানে সবাই থাকবো। ৩০ ডিসেম্বর ধানের শীষে ভোট দিয়ে মনিরুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী করে আপনাকে (লোটাস কামাল) এখান থেকে বিদায় করবো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এই আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দেবো। আমরা এদেশে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবো। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন আজকে তারা এক হয়েছেন। আজকে বুঝতে হবে,জানতে হবে এখানে ধানের শীষকে জয়ী করতে না পারি তাহলে মনিরুল হক চৌধুরী বের হবেন না, গফুর ভুঁইয়া বের হবেন না, মোবাশ্বের আলী ভুঁইয়া বের হবেন না, হাজারো নেতা-কর্মী যাদের মিথ্যা মামলায় জেলে রেখে তারা কেউ বের হবেন না। সবচেয়ে বড় আমাদের গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি হবেন না। ফিরিয়ে আনতে পারবো না আমাদের নেতা তারেক রহমানকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেজন্য জোটবদ্ধভাবে সাহস করে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। যতই বিপদ আসুক, যতই ভয় দেখাক, হুমকি দেখাক, যতই গ্রেফতার করা হোক কোনও কিছুর কাছে আমরা মাথানত করবো না। ৩০ তারিখ পর্য্ন্ত জনগণের ঘরে ঘরে যান, ভোট চান।’
সভায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আগামী ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তির দিন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর মানুষের মুক্তির দিন।’
বঙ্গবীর আরও বলেন, ‘আপনাদের বলতে চাই, আলেমের ঘরেও জালেম হয়। আপনারা শৃঙ্খলা রাখতে পারেন, উস্কানির মধ্যেও যদি শৃঙ্খলা রাখতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি একাত্তর সালে যেভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পারেনি, আগামী ৩০ ডিসেম্বরও এই সরকার পারবে না। দারোগা-পুলিশ দিয়ে যাই হোক নির্বাচনে জয়লাভ করা যায় না। ইনশাল্লাহ আপনারা যদি আপনাদের নেত্রীর মুক্তি চান তাহলে ৩০ ডিসেম্বর ধানের শীষে ভোট দিতে হবে। মনে রাখতে হবে সারা দেশে ধানের শীষের প্রার্থী একজনই, তিনি হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। মনিরুল হক চৌধুরী, আমাদের মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী এরা ধানের শীষের প্রতীক মাত্র।’
শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে কাদের সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘তারা বলে তারা নাকি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। আমি বলছি, আমরা স্বাধীনতার পক্ষে নয়, আমরাই স্বাধীনতা। যেখানে জিয়াউর রহমান আছে, যেখানে ড. কামাল হোসেন আছেন, যেখানে আ স ম আবদুর রব আছেন, যেখানে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আছেন, যেখানে মান্না আছে সেখানে কি পক্ষ লাগে? আমরাই স্বাধীনতা।’
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনাদের বলব, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে, রাতে গ্রেফতার করছে, অত্যাচার করছে- এদিকে তাকাবেন না। আমার মনে হয়, এ সরকার ও তাদের পুলিশ ভয় পেয়েছে। তাই তারা আক্রমণ করছে। আমরা ভয় পাবো না। ভোটের দিন সকলে ভোট কেন্দ্রে যাবেন।’
নাঙ্গলকোট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম খান সরকারি দলের পক্ষ অবলম্বন করে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ এনে অবিলম্বে তাকে প্রত্যাহারের দাবি জানান ফখরুল।
কারাগারে দীর্ঘ ১১ দিন ধরে অনশনে থাকা মনিরুল হক চৌধুরীর প্রতি বিনীত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মনিরুল হক চৌধুরী জেলখানায় ১২ দিন ধরে অনশন করছেন। কেন? তাকে তার নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, নির্বাচনে কোনও সুবিধা দেয়া হচ্ছে না তাকে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমি এই মঞ্চ থেকে আহ্বান জানাতে চাই, আপনি (মনিরুল হক চৌধুরী) কার কাছে দাবি জানাবেন। এদের তো কানে মোহর দিয়ে দিয়েছে আল্লাহ। এরা কিছু শুনতে পায় না, বধির। এদের বুকের মধ্যে কোনও দয়া-মায়া নেই, মানুষের জন্য মন কাঁদে না এদের। আমি বলছি এখানে লাখো মানুষ অনুরোধ জানাচ্ছে দয়া করে আপনি অনশন ভঙ্গ করুন, এদেশের মানুষের জন্য আপনি বেঁচে থাকুন।’
এসময় মনিরুল হক চৌধুরীর মেয়ে ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস অশ্রুসজল কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাবাকে আজকে সরকার অন্যায়ভাবে আজ কারাগারে বন্দি করে রেখেছে। ৩০ তারিখ এর জবাব দিতে হবে ধানের শীষের ভোট দিয়ে। কুমিল্লার ছেলেরা মার খাচ্ছে আমার বাবার মুক্তির দাবিতে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হউন। ৩০ ডিসেম্বর একসঙ্গে ভোট দিতে প্রস্তুতি নিন।’
চান্দিনার নির্বাচনী সভা শেষ করে কুমিল্লা-১০ আসনে নির্বাচনী সভায় যোগ দেন বিএনপি মহাসচিব। কুমিল্লা-১০ আসনের প্রবেশপথে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা সহকারে মির্জা ফখরুলের গাড়ি নিয়ে আসে সোয়াগাজীর চৌয়ারায় মনিরুল হক চৌধুরীর বাসায়। সেখান দুপুরে খাবার খেয়ে নির্বাচনী সভায় আসেন ফখরুল।
সোয়াগাজীর চৌয়ারায় রাস্তার দুই পাশে মনিরুল হক চৌধুরীর ছবি সম্বলিত পোস্টার দেখা গেছে। এরকম পোস্টার চান্দিনায় ধানের শীষের প্রার্থী রেদোয়ান আহমেদের নির্বাচনী এলাকা দেখা গেছে।
নির্বাচনী সভায় দলের কেন্দ্রীয় নেতা কামরুজ্জামান রতন, মিয়া মোস্তাক আহমেদ, আবদুল আউয়াল খান, শামসুদ্দিন দিদার, মইনুল ইসলাম বাবুল ও শহিদুজ্জামান মজুমদার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।