বৃহত্তর কুমিল্লার চার মন্ত্রী মিলে কুমিল্লা বিভাগ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি!
ডেস্ক রিপোর্টঃ আইন, অর্থ, শিক্ষা, স্হানীয় সরকার মিলে কুমিল্লা বিভাগ কার্যকর দাবি কুমিল্লার মানুষের। কুমিল্লা বিভাগ নিয়ে কথা হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র রাকিবের সাথে সে প্রতিবেদককে বলেন: শুনিতেছি, ‘ময়নামতি’ নামে নয় কুমিল্লাকে বিভাগ করা হবে ‘মেঘনা’ নদীর নামে। ভালো কথা, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীধন্য এদেশের যেকোনো কিছুর নামই নদীর নামে হতে পারে। কিন্তু কথা আছে। শুধু কুমিল্লাকে নদীর নামে বিভাগ করলে নদীধন্য পৃথিবীর এই বৃহত্তম ব-দ্বীপ যে সত্যিকারের নদীময় তা বুঝানো যাবে না। এজন্য অন্যান্য বিভাগগুলোর নামও নদীর নামে করতে হবে।
গুরুত্ব বিবেচনায় প্রথমেই বদলাতে হবে ঢাকা বিভাগের নাম। আমরা সবাই জানি ও পড়ি- ‘ঢাকা স্টান্ডস্ অন বুড়িগঙ্গা (Dhaka stands on Buriganga)’ বা ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। আবার, বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীর যে অবস্থা! আগামী ১০০ বছরে ঐতিহ্যবাহী এ নদীটি হারিয়েও যেতে পারে। কাজেই ঢাকা বিভাগকে এখনই ‘বুড়িগঙ্গা’ নদীর নামে নামকরণ করতে হবে। আর এ পদক্ষেপের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদীকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব এখনই নিতে হবে। না হয় নতুন প্রজন্ম এককালে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী না পেয়ে হতাশায় ভোগবে। যদি ঢাকা বুড়িগঙ্গা নামে বিভাগ হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম অন্তত স্বস্তি নিয়ে বাঁচতে পারবে অার মন ভরে পড়বে- ঢাকা স্টান্ডস্ অন বুড়িগঙ্গা।
বাংলাদেশের বন্দর নগরী বললেই চট্টগ্রামের নাম চলে আসে। আর এ বন্দর নগরীটি কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। কাজেই, চট্টগ্রাম নামটি ‘কর্ণফুলী’ নদীর নাম দ্বারা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন উঠার কথা নয়। কর্ণফুলী নদী ছাড়াও আরও কিছু নদী উল্লেখযোগ্য যেমন – সাঙ্গু, ডাকাতিয়া, হালদা ইত্যাদি। ইচ্ছেমতো নদীর নাম বাছাই করে চট্টগ্রাম বিভাগকে নামগত দিক দিয়ে উন্নত করতে হবে।
রংপুর বিভাগে অাছে নানান নদী। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা। অন্যান্য বিভাগের নাম পদ্মা ও মেঘনা রাখা গেলে রংপুর বিভাগের নাম পরিবর্তন করে ‘যমুনা বিভাগ’ রাখা শতভাগ যৌক্তিক হবে। আবার, চাইলে ব্রহ্মপুত্র নদের নামে হলেও রংপুর বিভাগের নামগত উৎকর্ষ সাধন করতে হবে।
খুলনা বিভাগকে নদীর মেলা বললে ভুল হবে না। নদী হিসেবে মধুমতি, বলেশ্বর, সোনাই, কালিন্দি, হাড়িয়াভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদীর নাম বলা যেতে পারে। সোনাই নদীর নামে খুলনা বিভাগের নাম হতে পারে ‘সোনাই বিভাগ’! মাইকেল মধূসুদন দত্তের নাম তো সবাই জানেন। খুলনা বিভাগে তার বাড়ি। এটাও জানেন যে, ইংরেজী সাহিত্যে খ্যাতি লাভের মোহে তিনি প্রবাসে চলে গিয়েছিলেন। প্রবাসে থেকেও এদেশকে ভুলে থাকতে পারেননি তিনি। বিশেষভাবে কপোতাক্ষ নদ কবিকে বার বার অাকর্ষণ করেছে। তিনি কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এইটা বুঝি কোনো কাজ হইল বলেন? নদীর নামে বিভাগ করবেন অার খুলনা বিভাগের নামটা ‘কপোতাক্ষ’ নদের নামে হবে না, তা কী সুবিচার হয় বলেন! বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা মাইকেল মধূসুদনের প্রিয় নদের নামকে এভাবে দৃষ্টির অগোচরে যেতে দেয়া আদৌ ঠিক হবে কী? কাজেই খুলনা বিভাগকে ‘কপোতাক্ষ’ নদের নামে নামকরণের মাধ্যমে খ্যাতিমান কবির প্রিয় নদকে সংরক্ষণ এবং নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর নামে বিভাগ ঘোষণার উৎসবকে ত্বরান্বিত করতে হবে।
অনুরূপভাবে, বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগকে নদীর নামে নামকরণের মাধ্যমে নদীমাতৃক এই দেশটাকে বিশ্বের বুকে নতুনভাবে পরিচিত করানো যেতে পারে। আর যদি অন্য সকল বিভাগের নাম নদী কিংবা অন্য কোনো নামে নামকরণ না করা হয়, তাহলে শুধু কুমিল্লার বেলায় কেন এমন নীতি? অঞ্চলভেদে কি নাগরিক অধিকারে তারতম্য আছে? যদি না থাকে, তাহলে কুমিল্লা অঞ্চলের সকল মানুষের প্রাণের দাবি অনুসারে জেলাশহর কুমিল্লার নামেই কুমিল্লা নামক বিভাগ ঘোষণা করতে হবে।
প্রসঙ্গ যখন “কুমিল্লা”
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন ও দেখিয়েছিলেন কোটি কোটি বাঙালিদের এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তব করে বিশ্বমানচিত্রে চিত্রিত করেছিলেন লাল-সবুজের শান্তিময় বাংলাদেশকে, তিনি হলেন আমাদের সবার প্রিয় ও বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্ক রচনা করেছিল কুমিল্লার একটা মানুষ, যার নাম খন্দকার মোশতাক। আমরা সবাই মোশতাককে ঘৃণা করি। নাকি কেউ বলতে পারবে যে, কুমিল্লার মানুষ কোনো সময় মোশতাককে সমর্থন দিয়েছে বা আজকেও সমর্থন দিচ্ছে? পারবে না। যেখানে সারা দেশের মানুষের সাথে মোশতাকের নিজ জেলার মানুষেরাও তাকে ঘৃণা করছে এবং বর্জন করেছে, সেখানে আজও কেন শুধু একটা মানুষের জন্য কুমিল্লার সকল মানুষকে ছোট করে দেখা হচ্ছে? কুমিল্লাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। একটা মানুষের জন্য আদৌ বাকি ৯৯ জন মানুষ খারাপ হতে পারে না।
আর যদি ইতিহাস থেকে বলি তাহলে এমন উল্লেখযোগ্য সূর্যসন্তান পাওয়া যাবে, যারা কুমিল্লার বাসিন্দা ছিলেন। এগুলো আসলে সুরওয়ালা বাঁশির হৃদয়হরণ করা সুর, কেউ কি পারবে অস্বীকার করতে? শুধু একজনের কথা বলবো। এ কথা কে না জানে যে, ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তান গণপরিষদে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটুকু করেছিলেন কুমিল্লার একটা মানুষ, তিনি আমাদের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সেদিন তো এই পূর্ব-পাকিস্তানের আরও প্রতিনিধি ছিল। কোথায়, অন্য কেউ তো বাঙালির এই প্রাণের দাবিটুকু তুলে ধরেনি! যেখানে গণপরিষদের সবাই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেয়, সেখানে শুধু একজন হয়েও বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলা উত্তাল সমুদ্রে জাহাজ ভাসাবার মতো সাহসী পদক্ষেপ।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের পর এই বাংলায় যদি আর কোনো শের থাকে তাহলে তিনি হলেন আমাদের ‘শেরে কুমিল্লা’ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত! সেদিন তিনি আওয়াজ দিয়েছিলেন বলেই বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে অান্দোলনে নামার সাহস পেয়েছিল বাঙালি জাতি। আর রক্ত-সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষায় আজ এদেশের প্রতিটি মানুষ কথা বলতে পারছে।
এতকিছুর পরও কুমিল্লার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা অন্তত কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভবপর হওয়ার কথা নয়।
কেন কুমিল্লা নামেই বিভাগ হওয়া উচিত
অাপনি যদি আমাকে ঢাকার কথা বলেন, তাহলে আমাকে বুঝতে হবে ঢাকা মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ভাষার দাবিতে রক্তে রঞ্জিত সেই রাজপথ, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দান, আহসান মঞ্জিল, লালবাগের দুর্গ, পুরান ঢাকার বাকরখানি ও বিরিয়ানী ইত্যাদি। ঢাকা নামের সাথে এই সবকিছুর একটা সম্পর্ক আছে, ঐতিহাসিক সম্পর্ক। এখন যদি হুট করে ঢাকা নামটি পরিবর্তন করে দেন, তাহলে কী হবে! এককথায় ঢাকা তার ঐতিহ্য হারাবে, এতদিনের পরিচিতিগুলো নিমিষেই ফিকে হয়ে যাবে।
ঠিক তদ্রুপ, কুমিল্লা নামটি কয়েক বছর আগের দেয়া নাম নয়। কুমিল্লা নামের ঐতিহ্য আছে। কারণ, রসমালাই বললে আপনি বুঝেন দেশ-বিদেশখ্যাত কুমিল্লার রসমালাই, খাদি বললেও কুমিল্লার খাদি, শীতলপাটিতে খ্যাত কুমিল্লা। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র বাড়ি কুমিল্লায়, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর অাবদুল গণি ছিলেন কুমিল্লার মানুষ। নারী জাগরণের অগ্রদূত হয়েও যিনি আড়াল হয়ে আছেন, যিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মের ৪৬ বছর আগে জন্মেছিলেন তিনি হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী। ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম ‘নওয়াব’ উপাধি পাওয়া এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মানব সেবামূলক কাজের ক্ষেত্রে তৎকালে একমাত্র নারী নিদর্শন ছিলেন যিনি, তিনি এই কুমিল্লার মানুষ। ‘জননী সাহসিকা’ খ্যাত কবি সুফিয়া কামালও ছিলেন কুমিল্লার অধিবাসী। দেশের একমাত্র সার্ভে ইনস্টিটিউট কুমিল্লায়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (BARD) কুমিল্লায়, প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরের শহরটিও কুমিল্লা, বিভাগীয় শহর না হয়েও স্বতন্ত্র শিক্ষাবোর্ড আছে একমাত্র কুমিল্লায় ইত্যাদি।
যদি বলা হয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য স্থানের কথা সেটিও আমাদের কুমিল্লা। বঙ্গবন্ধুর মুখেও কুমিল্লার মানুষের কথা ছিল, তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে বলেছিলেন – “হাজী গিয়াসউদ্দিন নামে একজন বন্ধু ছিল আমার। তার বাড়ি কুমিল্লায়। যখন আর কোথাও টাকা জোগাড় করতে পারি নাই, তখন তার কাছে গেলে কখনও আমাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় নাই।” এখন, বিভাগ করার বেলায় কুমিল্লা নামকে আড়াল করা মানে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বন্ধু হাজী গিয়াসউদ্দিন সাহেবের কুমিল্লাকে আড়াল করা।
কাজেই, কুমিল্লা নামটির পরিবর্তন মানে কুমিল্লার ঐতিহ্যকে আধারে ঠেলে দেয়া। সবকিছু ছাপিয়ে প্রতিটি মানুষের একটা অঞ্চলগত আইডেন্টিটি আছে, যা প্রতিটি মানুষ ধরে রাখতে চায়। এসব কারণে অন্যান্য বিভাগের নাগরিকদের চাওয়ার সাথে মিল রেখে কুমিল্লার মানুষদেরও এই একটি চাওয়া। আর তা হচ্ছে- ‘ময়নামতি’ কিংবা ‘মেঘনা’ কিংবা ‘গোমতী’ নয়, ‘কুমিল্লা’ নামেই কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণা করা হোক।