কুমিল্লায় মহাসড়কের পাশে ছড়াছড়ি মাতৃ ভাণ্ডারের : প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতা
কুমিল্লার অনন্য মিষ্টি রসমালাই। আর এর সবটুকু জুড়ে রয়েছে মাতৃভাণ্ডার। নগরীর মনোহরপুর এলাকায় ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম থেকে এসে এক হিন্দু ব্যবসায়ী এখানে রসমালাইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয় মাতৃভাণ্ডার। কালের পরিক্রমায় তা এখন সুনাম ছড়িয়ে দেশজুড়ে।
বেশকিছু অসাধু ব্যবসায়ী মনোহরপুরের মাতৃভাণ্ডারের নামের আগে-পিছে বিশেষণ লাগিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ, বুড়িচং, চান্দিনা এলাকায় গড়ে তুলেছে শতাধিক মাতৃভাণ্ডার। অভিযোগ রয়েছে, এসব মাতৃভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন শতশত মানুষ রসমালাই কিনে প্রতারিত হচ্ছে।
যতটুকু জানা গেছে, গত উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে এক হিন্দু ব্যবসায়ী এসে কুমিল্লার মনোহরপুর এলাকায় রাজ রাজেশ্বরী কালীবাড়ির সামনে রাস্তার পাশে দই-মাঠা পরবর্তী সময়ে পেড়া বা সন্দেশ বিক্রি শুরু করেন। এরপর একসময় এই কালীবাড়ির সামনেই গড়ে তোলেন মাতৃভাণ্ডার নামে প্রতিষ্ঠানটি। পরে দেশ ছাড়িয়ে পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালির উপস্থিতি সেখানে পৌঁছে গেছে এর সুনাম। এই প্রতিষ্ঠানটির কোথাও কোনো শাখা নেই। প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে ক্রেতাদের।
দোকান মালিকপক্ষ মিষ্টি বিক্রির বিষয়ে কোনো তথ্য না দিলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রমতে, প্রতিদিন কমপক্ষে চার-পাঁচ হাজার কেজি রসমালাই এই প্রতিষ্ঠানের নামে সারাদেশে বিক্রি হয়। প্রতিদিন বহু মানুষ রসমালাই না পেয়ে ফিরে যায়। কুমিল্লায় নানা কারণে আসা প্রায় প্রতিটি মানুষ সময়-সুযোগ পেলে রসমালাই ক্রয় করতে ছুটে আসে মনোহরপুর এলাকায়। আবার অনেকে নামে চিনলেও প্রকৃত মাতৃভাণ্ডারের অবস্থান না জানার কারণে মহাসড়কের পাশের দোকান থেকে ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে থাকা দোকানগুলোও মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই বলে রেলপথের যাত্রীদের কাছে প্রতিদিন বিক্রি করছে। এখানেও বিক্রেতারা মাতৃভাণ্ডারের প্যাকেটের অনুরূপ প্যাকেট ও প্লাস্টিকের কৌটায় রসমালাই সরবরাহ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র আরও জানায়, রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিলাসবহুল পাঁচ তারকাসহ সারাদেশের নামিদামি সব হোটেলেই কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের আলাদা কদর রয়েছে। এছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী এখান থেকে ক্রয় করে অন্যত্র বিক্রি করছে কিছুটা বেশি মূল্যে। এই যখন কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের অবস্থা তখন বিগত এক দশক ধরে কুমিল্লার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মাতৃভাণ্ডারের আগে-পিছে ময়নামতী, আদি, কুমিল্লার, দি কুমিল্লা ইত্যাদি নানা বিশেষণ লাগিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গড়ে তোলে কমপক্ষে শতাধিক মাতৃভাণ্ডার নামে মিষ্টির দোকান।
সরেজমিন ঘুরে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, চলন্ত পথের বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা মাতৃভাণ্ডার দেখে প্রতিদিন রসমালাই কিনে প্রতারিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বেছে নিয়েছে মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের যেসব এলাকায় উন্নতমানের হোটেল-রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে সেসব এলাকা।
সূত্র আরও জানায়, মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা মাতৃভাণ্ডার নামে প্রতিষ্ঠানগুলো পাইকারি বা খুচরা দু’ভাবেই রসমালাই বিক্রি করছে। তারা কুমিল্লা মহানগরীর মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভাণ্ডারের মিষ্টির প্যাকেটের আদলে প্যাকেট ও প্লাস্টিকের পাত্র তৈরি করে রসমালাই মাতৃভাণ্ডার নামে বিক্রি করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র আরও জানায়, এসব দোকানে প্রতিকেজি রসমালাই পাইকারি সর্বনিম্ন মূল্য ১২০ টাকা। খুচরো সর্বোচ্চ মূল্য ৩০০ টাকা। অথচ মনোহরপুরের মাতৃভাণ্ডার তাদের প্রতিকেজি রসমালাই ২৬০ টাকায় বিক্রি করছে। এই প্রতিষ্ঠানের রসমালাইয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা অনেক দিন ফ্রিজে রেখে খাওয়া যায়। কিন্তু মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই এক দিনের বেশি রাখা যায় না। দিন দিন মহাসড়কের পাশে মাতৃভাণ্ডারের নামে এভাবে প্রতারিত হলেও কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। ফলে প্রতারিত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মহাসড়কের পাশে মাতৃভাণ্ডার নামে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, বিষয়টি সত্য। তবে তারা প্রত্যেকেই যে যে নামেই দোকান চালু করেছে, সেই নামেই ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ কোনো ব্যবসায়ী এরকম অভিযোগও করেনি। তারা আরও বলেন, কুমিল্লার মনোহরপুরে মাতৃভাণ্ডার নামে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, সেটিই সারাদেশ পেরিয়ে বিশ্বের বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয়।