লটারির ফাঁদে ‘কুমিল্লা বাণিজ্য মেলা’

কুমিল্লা নগরীর কেন্দ্রস্থলে আয়োজিত ‘বাণিজ্য মেলা’ এখন রীতিমতো এক জুয়ার আসরে পরিণত হয়েছে। লটারির নামে প্রতারণার অভিযোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন জেলার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। আয়োজকদের বিরুদ্ধে উঠেছে কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যের অভিযোগ। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে পুরো শহর পড়বে অর্থনৈতিক সংকটে।

জানা যায়, গত ২৪ এপ্রিল নগরীর জাঙ্গালিয়া ডিওএইচ চত্বরে শুরু হয় ‘কুমিল্লা বাণিজ্য মেলা’। নির্ধারিত সময় ছিল ১৪ জুন পর্যন্ত, কিন্তু আয়োজকরা মেয়াদ বাড়িয়ে আরও ১৫ দিন বাড়িয়ে এখনও চালাচ্ছেন মেলাটি। মেলায় সবচেয়ে আকর্ষণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ২০ টাকার লটারি টিকিট। টিকিটের লোভে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন ভিড় করছেন হাজারও মানুষ।

লটারিতে সোনা, মোটরসাইকেলসহ নানা পুরস্কারের লোভ দেখানো হচ্ছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, টিকিট বিক্রির তুলনায় পুরস্কারের সংখ্যা খুবই কম। মেলা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১০-১৫ লাখ টাকার পণ্য। এই পার্থক্যের অর্থই আয়োজকদের পকেটে যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

মেলায় গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন অনেকেই। কুমিল্লা সদরের এক প্রবাসীর স্ত্রী রুবাইয়া খানম বলেন, এক ভরি সোনার চেইন বিক্রি করে টিকিট কিনেছিলাম। ভাবছিলাম ছয় ভরি পাব। এখন কিছুই নেই। সংসার চালানোই কঠিন হয়ে গেছে।

জোহরা বেগম নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিক লটারির টিকিট কেনার জন্য এক লাখ টাকা কিস্তিতে তুলে দেন। টিকিটে কিছু না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে স্ট্রোক করে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

মেলার আয়োজক হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে মো. বিল্লাল হোসেনের নাম। স্থানীয়ভাবে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন পরিচিত মুখ। তার বিরুদ্ধে মেলার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে লটারির নামে জুয়া চালানোর অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, বিল্লালের ছত্রছায়ায় বহু বছর ধরে এমন কর্মকাণ্ড চলছে। প্রশাসন সব জানে, কিন্তু কিছু বলছে না।

বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘পারলে নিউজ করেন।’ তার এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, আয়োজকদের পেছনে শক্তিশালী প্রভাবশালী মহল রয়েছে।

মেলার সময় সন্ধ্যার পর জাঙ্গালিয়া এলাকা ও আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে। টমটম ব্রিজ, মেডিকেল রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে গাড়ি চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি চুরি, ছিনতাই ও নারীদের যৌন হয়রানির মতো অপরাধও বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছে দর্শনার্থীরা।

এ জুয়ার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে কুমিল্লার তরুণ প্রজন্ম। ‘জাঙ্গালিয়া যুব সংঘ’ এবং ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে মানববন্ধনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এটা আর কোনো মেলা নয়, বরং পুরো শহরের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের ফাঁদ।

এত বড় আয়োজন হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, প্রশাসন তাহলে কী করছিল?

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ধরণের লটারির ফাঁদে পড়ে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে কুমিল্লার সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

কুমিল্লাবাসীর একটাই দাবি—লটারির নামে এই জুয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এবং আয়োজকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আরো পড়ুন