কুমিল্লা সদর উপজেলার রিকশা চালক মান্নানের যাপিত জীবন
খালেদ সাইফুল্লাহঃ আবদুল মান্নান। তার ভাষ্যে বয়স সত্তর পেরিয়ে দুই বেশি মানে ৭২। জীবনের অর্ধেক কাটিয়েছেন বছরিয়া কামলা হিসেবে সূবর্নপূরের কোন এক গৃহস্থের কাছে। সেকথা আজ থেকে ৩৫ বছর আগের। জীবনের ঘানি টানতে রিকশা চালক হিসেবে কাটিয়ে দেন আজকের দিন পর্যন্ত। একাত্তরে যুদ্ধের সময় মহাজনের সাথে ভারতে আশ্রয় নেন। পরে দেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধটা কেমন দেখেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় আমি দেড়মন পোজা নিতে পারি। পাঞ্জাবীরা যখন আমাদের এলাকায় বাড়িঘরে আগুন দেয় তখন জীবন বাঁচাতে ভারতে ঢুকে পড়ি। ভারত আমাদের বাড়ির পাশেই সীমান্ত পেরুলে।
লড়াই সংগ্রামের জীবনে ৬ সন্তানের জনক এই বৃদ্ধ মান্নান। ৩ ছেলে ৩ মেয়ের ভরন পোষন চালিয়ে গেছেন অলিগলি পথে হেকে যাওয়া এই মানুষটি। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে আজ তার তিন ছেলে আলাদা বসবাস করলেও কেউ বাবার খবর রাখে না। মেয়েদের বিয়ে দিছেন। তারা স্বামী সন্তান সহ তার ভিটেতেই থাকছেন। কেউ অটো চালায় কেউ টুকিটাকি কাজ করে সংসার চালায়। বৃদ্ধ মান্নান ও তার ষাটোর্ধ স্ত্রীর ভরন পোষন মেয়েরাই দেখে। তবুও অভাবের সংসারে প্রতিদিনই রিকশা নিয়ে বের হন মান্নান। দিনের উপার্জন টার্গেট ২০০ টাকা। কিন্তু কখনো কখনো ১৫০ টাকা নিয়েও ফিরতে হয় তাকে।
তার অনুযোগ, অনেকেই তার রিকশায় চড়তে চান না। বৃদ্ধ বলে এড়িয়ে যান। সন্ধ্যার পর চোখে ভালো দেখতে পারেন না, তাই রিকশা নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি।অভাবের জীবনে স্ত্রী নাতি নাতনীদের নিয়ে তিনি বেশ সুখি বলেই জানান। ডায়াবেটিস কিংবা কোন জটিল রোগ নেই দাবি তার। ছেলেরা পাশে নেই কেমন আছেন, বলতেই চুপ করে একটু হেসে বললো তারার ভাজে তারা চলে গেছে, কি করবো, মেয়েরা আমাদের দেখে রাখে। কি লাগবে তারাই নিয়ে আসে।
হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটির হাড় ভাঙা খাটুনী হয়তো আমাদের চোখে পড়ার মতো ঘটনা হয় না, বেশিরভাগ সময় ব্যস্ততার কারনে এড়িয়ে যাই আমরা। আমাদের ক্ষুদ্র সহযোগিতা এ মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে পারে। পরনের লুঙ্গী ছেড়া, ঘাম ভিজে আবার শুকিয়ে গেছে পরনের শার্টটি। এমন মানুষের পাশে বসে পড়ন্ত বিকেলের সন্ধ্যাটা কেটে গেল আমাদের। অর্থাৎ আমি ও আমার অগ্রজ মোবারক ভাইয়ের। মাগরিবের আজান শেষে আমরা দাড়িয়ে গেলাম সবুজ দূর্বাঘাসে পরম প্রভূর প্রার্থনায়। গোমতীর কূলে ঝিরঝিরে বাতাসে আমি যখন দূর্বাঘাসের জমিনকেই জায়নামাজ বানালাম তখন পশ্চিমাকাশ লালিমার আভায় ছেয়ে গেছে। আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যে জীবন সংগ্রামী আবদুল মান্নানকে একদিনের আনন্দ দেয়ার প্রচেষ্টা চালালাম। তিনি আমাদের পিঠে হাত রেখে দোয়া করলেন। তার কোন ফোন নাম্বার নেই, যোগাযোগের অন্য উপায় জেনে রাখলাম।
বৃদ্ধ মান্নান নিজ এলাকার এক ঐতিহাসিক ঘটনা জানান আমাদের। বলেন, নটী মসজিদের গল্প। নদীর ভেরিবাঁধের পরেই নন্দীগ্রাম। শতবর্ষ পূর্বে সে গ্রামের এক নর্তকী মহিলা জীবনের উপার্জন দিয়ে নির্মান করেন নটী মসজিদ। মানুষকে তার দানের কথা গোপন রাখতে বলা হলেও মসজিদ নির্মানের সময় তা জানাজানি হয়ে যায়। তাই আজ অব্দি সেই মসজিদে কোনদিন আজানও হয়নি, নামাজও হয়নি। সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষন এবং দখলদারদের কারনে সেটি এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। কুমিল্লা সদর উপজেলার আমড়াতলী গ্রামের আব্দুল মান্নান বঞ্চিত সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা থেকে। পাচ্ছেন না বয়স্ক ভাতা কিংবা ভিজিএফ কার্ড। প্রত্যাশা থাকবে এই বৃদ্ধ মান্নানের পাশে সহায়তার হাত বাড়াবেন স্থানীয় চেয়ারম্যান।