কুমিল্লায় জন্ম নিবন্ধন নিয়ে সীমাহীন দূর্নীতির অভিযোগ
আবু সুফিয়ান রাসেলঃ ২০০৬ সালে দেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা কার্যকর হয়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এক যুগ অতিবাহিত হলেও কাঙ্খিন সেবা পাচ্ছে না কুমিল্লা জেলার নাগরিকরা । ক্ষোভ রয়েছে জনমনে। ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ মাথায় নিয়েই বছরের পর বছর, কাজ করছে বিভাগটি। সেবা প্রদানে ধীরগতি, রশিদ ছাড়া দেলনদেন, অতিরিক্ত টাকা আদায়, দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের অপেক্ষাসহ বহু অভিযোগ। এ সব কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া ও গ্রাম হবে শহর এ স্বপ্নের স্থানীয় সরকারের প্রথম সিঁড়িতেই বাঁধা গ্রস্থ হচ্ছে।
অবশ্য সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান নিরূপন করলে, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আন্তরিকতায় সাফল্যের পাল্লাই ভারী হবে।
স্থানীয় সরকারের সূত্র মতে, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক), ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, ৮টি পৌরসভা ও ১৭টি উপজেলা রয়েছে। কুমিল্লা জেলায় শুরু থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৯৬৩৬০৭ টি ও ৪৬৮১৯১ টি মৃত্যু সনদ প্রদান করা হয়েছে। চলতিবছরে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১২১২৮৩ টি জন্ম সনদ ও ১০১৯৪ টি মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। চলতি বছরের কোয়ার্টার প্রতিবেদন অনুযায়ি জন্ম নিবন্ধনের ফি আদায়ে র্শীষে রয়েছে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা। যার আহরিত ফি পরিমাণ ২,৪৫,০০০ টাকা, পরের অবস্থান মুরাদনগর ২,২৯,৫৭৫ টাকা। জন্ম সনদ সংশোধনে পেন্ডিং আবেদন দিনদিন বাড়ছে , বিগত মাসের জের সহ ১৯৪৯টি আবেদন জমা হয়ে আছে। গত মাসে ৫৪৪টি আবেদন জমা হয়েছে, এর মধ্যে ৩৭৪টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সালের স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী , জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বিনা মূল্যে, ৫ বছরের মধ্যে ২৫ টাকা, ৫ বছর পর থেকে ৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তবে এর থেকে কয়েকগুণ বেশী ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
মালেক রিপন নামে এজজন জানান, স্কুল ও টিকা কেন্দ্রকে আরো তৎপর হতে হবে। ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের প্রথম রাস্তা খুলে দেয় স্কুলের শিক্ষকরা। অভিবাবকদের কথার উপর ভিত্তি করে, বয়স লিখে সনদ দিয়ে দেয়। চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলর অফিস এ সূত্র ধরে সনদ প্রদান করে থাকে। অন্য একটি বিষয় হলো, টিকা কেন্দ্রের শেষ দু’টি টিকা যদি জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদর্শন করে,টিকা নিতে হবে। কারণ ৮-১০ মাসের শিশুর নামও রাখা হয়ে যায় এবং জন্মনিবন্ধন ও করা হয়ে যায়। তাহলে একাদিক জন্মনিবন্ধনের সুযোগ থাকবে না।
ব্রাক্ষণপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দিন মাষ্টার বলেন, সমস্যা নিয়ে বহু বছর বলতেছে। নেট থাকলে সার্ভার সমস্যা, সর্ভার ঠিক থাকলে নেট সমস্যা। কার কাছে বলবো, কোন সমাধান নেই।
বরুড়া উপজেলার চিতড্ডা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, সার্ভারের অবস্থা এতোটাই খারাপ ৩/৪ দিন চেষ্টা করে ২/১টা নিবন্ধন করা যায়। মুত্যু নিবন্ধনে দেখা যায়, যাদের বয়স ৩০-৪০ বছর তাদের জন্মনিবন্ধন ওয়েব সাইটে নেই, তাহলে তার মৃত্যু নিবন্ধন দেওয়ার সুযোগ থাকে না। সাধারণ মানুষ এ বিষয়টা বুঝতে চায় না, যার জন্মই হয়নি, তার মৃত্যু হবে কী করে? আবার দেখা যায়, ৫০ বছর আগে একজন লোক মারা গেছেন, এখন জমি বন্টন করতে চায় তার পুত্রের ছেলের ছেলোরা। এ ব্যক্তির মৃত্যুর সনদ নিয়েও আমাদের নানামুখি সমস্যায় পরতে হয়।
কুসিক ওয়ার্ড সচিব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও ২২ নং ওয়ার্ড সচিব মো. ওমর ফারুক পাটোয়ারী জানান, সার্ভার লগ ইন করতে ৩০ মিনিট থেকে ৫০ মিটিন সময় লেগে যায়। প্রায় সময় ফাইল এরোর দেখায়। একটা জন্মনিবন্ধ যাচাই করতে গেলে নানা বিড়ম্বনা। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে কাজটা শেষ করে যখন জন্মনিবন্ধন পেজটা ডাউনলোড করি, তখন দেখা যায় এ পেজটা আর ডাউনলোড হয় না। এ টু আই প্রোগ্রামের সফলতা কোথায়? উদ্দেশ্য কী? সমস্যা একদিন বা দু’দিন হতে পারে। তবে বছরের পর বছর এ সমস্যা মেনে নেওয়ার মতো নয়।
কুসিক ২১ নং ওয়ার্ডের সচিব ও তরুণ উদ্যোগতা মো. কাউছার জানান, প্রথম দিকে যখন কাজ করেছি তখন যে গতি ছিলো দিন দিন গতি আরো কমছে। ছুটির দিনে, রাত ১/২টার পর নেটে বসে থাকি জন্ম নিবন্ধনের কাজ করার জন্য তখন ও সার্ভার ঠিক ভাবে কাজ করে না। একটা জন্ম নিবন্ধন করতে ২ থেকে আড়াই ঘন্টা চলে যায়। অথচ এটা সর্বোচ্চ ৩ মিনিটের কাজ।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) ফুড এন্ড স্যানিটারী অফিসার ও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেছবাহ উদ্দীন মনে করেন, সার্ভারের সাথে ফি অটোভাবে এড করে দেওয়া যেতে পারে। ফলে অতিরিক্ত ফি নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ২০১৩ সালে আইন করা হয়েছে একই ব্যক্তির একাদিক জন্মসনদ করলে পাঁচ হাজার টাকা জারিমানা। বিষয় হলো এটা ধরার কোন পদ্ধতি এখানে নেই। প্রথম দিকে নিবন্ধনকারীর নাম, পিতা ও মাতার নাম হুমহু হয়ে গেলে এটা সার্ভার গ্রহণ করতো না। এখন এ সিষ্টেমটা নেই। আমি মনে করি পিতা মাতার এনআইডি নম্বর সন্তানের জন্মসনদ নিবন্ধনে ওয়েব সাইটে যুক্ত করলে একাদিক নিবন্ধন করার সুযোগ থাকবে না। এ কর্মকার্তা আরো বলেন, নিবন্ধন থেকে প্রাপ্ত অর্থ একটি একাউন্টে রাখা হয়, যা অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা হয় না। তবে কাগজ, কালি, বিদ্যুতসহ সকল খরচ রাজস্ব থেকে যাচ্ছে। এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক রাজ আহাম্মেদ বলেন, আমরা উন্নত মানের অন্য একটি সার্ভার ব্যবহার করি ফলে আমাদের তেমন কোন সমস্যা হয় না। জাতীয় নিবন্ধন সার্ভার থেকে পাসপোর্ট অফিসের সার্ভার পৃথক। আমরা খুব দ্রুতই এর যাচাই কাজ শেষ করতে পারি।
জেলা স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান (উপ-সচিব) বলেন, অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ আসলে আমরা সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। আর যে অফিসে রশিদ প্রদান করে না, সেখানেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগে কুমিল্লায় দু’জন উদ্যোগতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সার্ভার ধীরগতির ফলে কাঙ্খিত সেবা প্রদান করা যাচ্ছে না। এ অভিযোগ শুরু থেকেই। তাছাড়া কুমিল্লায় মানুষ বেশী, কাজ ও বেশী।এ বিষয়টি আমরা বহুবার রেজিষ্টার জেনারেলের কার্যালয়ে অবগত করেছি। সার্ভার সমস্যা নিয়ে ডিসি মহোদয়ের মাধ্যমে আমরা মন্ত্রণালয়কে অবগত করেছি। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে এটাই সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যাশা।