অপার সৌন্দর্য্যময় কুমিল্লার “ময়নামতি রানীর প্রাসাদ” (ভিডিও)
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন, সাহেবের বাজার এলাকায় রাণী ময়নামতির প্রাসাদ এবং মন্দির অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে এটি “রানী ময়নামতি প্রাসাদ” নামে পরিচিত। জানা যায় ১৯৮৮ সালে এর খনন কাজ শুরু হয়। এর পর অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়।
এই প্রাসাদটি লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সমতল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৫.২৪ মিটার।
লোকমুখে জানা যায় প্রথমে একটি ক্রুশাকার মন্দির ছিল এখানে । পরবর্তী সময়ে সংস্কার করে এটিকে ছোট আকারের মন্দির বানানো হয়। খননের কাজ করার সময় এখানে বেশ কিছু পোড়ামাটির ফলক এবং অলংকৃত ইট আবিষ্কৃত হয়েছে। খননের পরে বিশ্লেষকরা ধারনা করে এই প্রাসাদটি ৮ম থেকে ১২শ শতকের প্রাচীন কীর্তি। কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পূর্ব পাশে রাণী ময়নামতির প্রাসাদ অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।
পাহাড় ও সমতল ভূমিতে স্থানটি দেখতে অপূর্ব। কুমিল্লার লোকেরা গল্প অথবা মজা করে বলে থাকে “আমরা নিরানব্বই রাজার দেশে বাস করি।” কথাটি শুধু মজা করার জন্য বলা হলেও লালমাই-ময়নামতি’র প্রায় সমস্ত এলাকা জুড়ে প্রাচীন কীর্তির যে নিদর্শন রয়েছে তা থেকে কমপক্ষে ৮টি রাজবংশের প্রায় ৩০ জন রাজার পরিচয় পাওয়া যায় ।
ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শতকে কমপক্ষে ৮টি রাজবংশ ময়নামতি অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। এখানে রয়েছে অনেক পুরাকীর্তি ও ধ্বংসাবশেষ। এগুলোর মধ্যে “রানী ময়নামতির প্রাসাদ” অন্যতম ।
প্রাচীনকালে বাংলাদেশের যেসব এলাকা সভ্যতা লাভ করেছিলো তার মধ্যে কুমিল্লার ময়নামতি অন্যতম। কুমিল্লার ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখিত ইতিহাস, বীরত্বের ইতিহাস। জেলাটি শিক্ষা-সংস্কৃতির পাদপীঠ নামে খ্যাত, খনিজ সম্পদে ভরপুর। জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও রয়েছে অপ্রকাশিত বহু আদি নিদর্শন যার খননকাজ শুরু করাই হয় নি এখনো । ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, কুমিল্লার ভূমি গঠনের ইতিহাস সাড়ে তিন কোটি বছরেরও অধিক। এর মধ্যে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়িয়া অঞ্চল হল পুরাতন অঞ্চল। প্রাচীনকালে লালমাই-ময়নামতির পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো মেঘনা নদী। কালের বিবর্তনে তা সরে অনেক পশ্চিমে চলে এসেছে। আর কুমিল্লার বুক চিরে প্রবাহিত নদী ‘গোমতী’ । কুমিল্লার আকর্ষণীয় স্থান লালমাইয়ের নামকরণ বিষয়ে পাওয়া যায় লাল মাটিতে গঠিত বলে নাম হয়েছে লালমাই। চন্দ্র বংশের চতুর্থ নৃপতি শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে এই পাহাড় শ্রেণিকে লালিম্ব পাহাড় বলা হয়েছে। অন্যদিকে গোপীচন্দ্রের মাতা ময়নামতির নাম অনুসারে পাহাড়ের নাম হয়েছে ময়নামতি। তবে এই নামেরও মতান্তর আছে। এক রাজার ছিল দুই কন্যা-একজনের নাম লালমতি, অন্যজনের নাম ময়নামতি। মেয়ে দুটির নাম অনুসারে পাহাড়ের নাম হয়েছে বলে মতামত প্রচলিত আছে, যাই হোক ইতিহাস সেদিকে গেলে কথা ফুরোবে না সহজে।
অর্থাভাবে বন্ধ থাকা খননকাজ আবার শুরু হয়ঃ
দীর্ঘ ১৯ বছর পর গত ০৫/১২/১৬ইং থেকে নতুন করে খননকাজ শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। উদ্বোধন করেন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম সরকার। এসময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় জনপ্রিয় চেয়ারম্যান জনাব মোঃ লালন হায়দার (এল এল বি) এবং ইউ পি সদস্যগন।
এখনো খনন কাজ চলছে, পাওয়া গেছে প্রাসাদের একটি গোপন সুরঙ্গ পথ এবং ছোট ছোট কামরা। খনন চলবে আরো। তবে এই খনন কাজ অতি সুক্ষ্ম হওয়ায় অত্যন্ত সাবধানে করতে হয়। আরো অর্থের জোগান প্রয়োজন এই খাতে।
১৯৮৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ সমতল ভূমি থেকে সাড়ে ১৫ মিটার উঁচুতে পাহাড়ের চূড়ায় সাড়ে ৩ মিটার খননের পর একটি সুড়ঙ্গপথের সন্ধান পায়। এই সুড়ঙ্গপথ ধরে খনন করে প্রাচীন এই প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ পাহাড়ে খননের ফলে চারদিকে প্রাচীন প্রাচীরের সন্ধান পাওয়া গেছে । প্রাচীরটি ১৭০ মিটার উত্তর- দক্ষিণে এবং ১৬৭ মিটার পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা । পূর্ব প্রাচীরের প্রায় মধ্যভাগ পরবর্তীকালে নির্মিত অসংখ্য কক্ষের নিদর্শনসহ একটি বহির্মুখী স্থাপত্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ সম্বন্ধে সঠিক কোন নিদর্শন দেয়া সম্ভব নয়। তবে খননের সময় দুইটি সোনার চুড়ির টুকরো, পিতলের আংটি, কয়েকটি পিতলের শলাকা, প্রস্থ ও গুটিকা এবং অলঙ্কৃত ইট পাওয়া যায় বলে জানা গেছে। স্থানটি দেখতে এখানে প্রতিদিন অনেক পর্যটক এলেও নেই কোন সুযোগসুবিধা। এমনকি এখানে পানীয় জল কিংবা শৌচাগারের কোনো ব্যবস্থাও নেই। চারদিকে বাউন্ডারি ওয়াল না থাকায় গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে প্রত্নস্থানটি ।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষী এই অপূর্ব নিদর্শন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় দর্শনীয় স্থানটির সংরক্ষণ ও রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া একান্তই প্রয়োজন। এর চার দিকে সিমানা প্রাচীর অথবা কাটাতারের বেড়া দেয়া প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বৈকি। এমনিতে ময়নামতির এলাকার মানুষ অতিথিসুলভ তবুও এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের স্থানীয়রা যাতে কোন ভাবেই কখনো বিরক্ত না করে সেদিকে সকলকে নজর নজর রাখতে হবে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এর মাধ্যমে এই স্থানটি ও হতে পারে কোটবাড়ি এলাকার মত একটি পর্যটন কেন্দ্র ।
ঢাকা থেকে কুমিল্লার মাত্র ৯৬ কিলোমিটারের। রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে বিভিন্ন বাস সরাসরি যাওয়া যায়। সময় লাগবে মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। বাসভাড়া জনপ্রতি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও ফেনীর যেকোনো বাসে চড়েও পৌঁছাতে পারেন। দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট গাড়ি থেকে নেমে রিক্সা করে ময়নামতি রানী বাংলো পৌছুতে ৫/৭ মিনিট লাগবে, কেবল ভাড়া নেবে ১০ টাকা জনপ্রতি । ইচ্ছে করলে রেলপথেও যেতে পারেন। তবে ট্রেনে অপেক্ষাকৃত সময় বেশি লাগবে বাস থেকে। ভ্রমণ করুণ আর ঘুরে দেখে আসুন সৌন্দর্যের লীলাভূমি সবুজের ছায়াভূমি কুমিল্লা। সঙ্গে কুমিল্লার বিখ্যাত খাদি’র পোশাক নিতে আর সারা দেশে বিখ্যাত মিষ্টান্ন ‘রসমালাই’ খেতে ভুলে গেলে আপনার কুমিল্লা আসাই বৃথা ।