কুমিল্লার প্রাচীন বাঈজীর মসজিদ, নামাজ হয়নি কোনো দিন!
প্রথম যেদিন বাঈজীর মসজিদ নামটি শুনেছিলাম তখন একটু অবাকই হয়েছিলাম, বাইজি বা নর্তকি নামে মসজিদ হয় কি করে ! আবার স্হানীয় ভাবে অনেকে এটিকে নটীর মসজিদ বলেও জানে ।
বিষয়টি নিয়ে জানার খুবই আগ্রহ হয়েছিল আমার, তখন আমার এক বন্ধু প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করে এবং ঐ এলাকা সম্পর্কে ভালো জানাশোনা আছে তাকে অনুরোধ করলাম সেই বাইজীর মসজিদটি আমাকে একটু দেখাতে।
বন্ধু আমাকে নিয়ে কুমিল্লার কাপ্তানবাজার হয়ে গোমতী নদী পেড়িয়ে বাধের ঠিক ঢালু জায়গাটায় তার মোটর সাইকেলটা দাড় করালেন কিন্তু এখানে কোন মসজিদ তো দেখছিনা। তখন বন্ধু আমাকে বলল, তুই কোন কথা বলবিনা চুপচাপ আমার সাথে আয়।
পাশে একটা করাত মিল। বন্ধু আমাকে নিয়ে সেই মিলে গিয়ে বসল। সেই মিলের মালিক তার পরিচিত তাই খানিকটা গল্প শুরু করে দিল কিন্তু আমার মধ্যে নটীর মসজিদ দেখার জন্যে একটা অস্হিরতা কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর বন্ধু বলল, একটু ইয়ে করে আসি আর আমিও ইয়ে করার জন্যে তার পিছুপিছু গেলাম।
মিলের ঠিক পেছনে ছোট্ট একটা ঝোপঝাড়। এরমধ্যেই একটা অতিশয় পুরনো জড়াজীর্ণ দালানকোঠার ভংগাবশেষ চোখে পড়ে। এই জীর্ণ দালানের চারদিকে অবৈধ দখলদাররা ধাক্কাতে ধাক্কাতে একবারে এটার গায়ে এনে লাগিয়েছে।
বন্ধু আমাকে বলল, এটাই নটীর মসজিদ। চারদিকে সবাই তার জায়গা দখল করে ফেলেছে তাই কেউ এটি দেখতে এলে এরা ক্ষিপ্ত হয়। আমার কাছে অবাক লাগল দখলদার যেভাবে দখল করেছে তাতে তো এতদিনে জীর্ণ দালানটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে অন্য কোন স্হাপনা তৈরি করে ফেলার কথা। কিন্তু এখানেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা এসে থমকে দাড়ায় আর সামান্য হলেও সত্যের কাছে মাথা নত করে।
নটীর মসজিদ বা বাঈজীর মসজিদ একটি সামাজিক বিতর্কিত বিষয়। তখনকার সমাজে বাঈজীর টাকায় নির্মাণ হয়েছে বলে এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল আর এখন পর্যন্ত মানুষ এটিকে নটীর মসজিদ বলে ডাকে কিন্তু তারপরও কেন তারা এই দুই শ বছরে মসজিদটি মাটির সাথে গুড়িয়ে দিতে পারছেনা কারণ একটাই মানুষ মুখে এটাকে যত তীরস্কার করুক আল্লাহর বিচারের উপর কারো হাত নেই। প্রত্যেকের মধ্যেই একটা বিষয় হয়তো কাজ করেছে মহিলাটি যেমনই হোক তার এই অনুশোচনা ক্ষমা প্রার্থনা হয়তো আল্লাহ ক্ষমাও করতে পারে। সে কারণেই কোন এক অসহায় নারীর করুন আর্তনাদের মিনার হয়ে আজও শতাব্দীর পর শতাব্দী দাড়িয়ে আছে এই কথিত বাঈজীর মসজিদ।
কিন্তু কে এই বাঈজী ? কেনইবা সে জীবনের শেষে এসে এই মসজিদটি নির্মাণ করে এতটা বিতর্কিত হয়ে গেছেন ? এইসব প্রশ্ন জানতে করাত মিল থেকে বের হয়ে হাটতে হাটতে একটু সামনে আমাকে নিয়ে গেছে মাষ্টার বন্ধু। সেখানে পরিচয় হয় আবুল হোসেন নামে এক বৃদ্ধের সাথে। খুব চমৎকার একটা সালাম দিয়ে আবুল হোসেনের সাথে অল্পতেই ভালো একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেললাম। তারপর শুরু করলাম বাঈজীর মসজিদ প্রসংগ।
কথা প্রসংগে আবুল হোসেন আমাকে হাত দিয়ে দেখালেন এই যে নুতন মসজিদটা দেখছেন এটাও সেই মহিলার নিজের জায়গায় মানুষ করেছে। সে একটু ক্ষোভ প্রকাশ করেই বললেন, বাঈজীর টাকায় মসজিদ করলে নামাজ পড়া যায়না কিন্তু বাঈজীর জায়গায় মসজিদ করলে সেখানে নামাজ পড়া যায়।
এরপর মুল ঘটনা জানার জন্যে তাকে নানা ভাবে চেষ্টা করলাম যাতে সে বলতে উৎসাহী হয়ে উঠে। আবুল হোসেন বলতে শুরু করলেন, প্রায় দুইশ বছর আগের কথা। তখন আগরতলার মহারাজার অধীনে বর্তমান কুমিল্লা জেলা ছিল। এই নন্দীরবাজারের একদল ছোট্ট শিশু পাশের জংগলে লাকড়ী কুড়াতে গেছে। হঠাৎ একটি মেয়ে শিশুকে বিষাক্ত সর্পে দংশন করেছে। গ্রামের ওঝারা এসে বলল, শিশুটির দম চেপে আছে তাকে কলার ভেলায় করে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে। সেই কথা মতো শিশুটিকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় গোমতী নদীতে। সেই ভেলা ভাসতে ভাসতে চলে যায় অনেকদুরে। একসময় এক বেধের চোখে পড়ে শিশুটি, সেই বেধে তাকে তুলে নিয়ে সুস্থ করে তুলে। শুরু হয় শিশুটির নুতন পরিচয়, বেধের সন্তান হিসাবে শিশুটি বড় হতে থাকে, নাচ গান আর সাপের খেলা শিখতে থাকে।
একদিন সেই বেধে পরিবার সাপের খেলা আর নাচগান দেখাতে আগরতলার রাজ পরিবারে যায়, সেখানে মহারাজ মেয়েটির নাচগান দেখে শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে রাজনর্তকি করে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। টাকার লোভে বেধে পরিবার মেয়েটিকে বিক্রি করে দেয়। রাজদরবারে আবার শুরু হয় অসহায় কিশোরীর জীবনে অন্য আরেক অধ্যায়। প্রকৃতিই তাকে একদিন মায়ের আচল হারা করেছিল আবার প্রকৃতিই আজ বেধে পরিবারের সাথে জন্মানো একটা হৃদয়ের সম্পর্ককে ছিন্ন করে আগরতলা রাজদরবারে পণ্য হিসেবে এনে হাজির করল। বাস্তবে এই অসহায় কিশোরীর জীবন নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতাই তার নিজের হাতে ছিলনা। এভাবেই বছরের পর বছর মেয়েটি কিশোরী থেকে যৌবনা হয়। তারপর ধীরে ধীরে বৃদ্ধা হয় একসময়। রাজদরবারে তার প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে তাই আবার তাকে নিয়ে নুতন খেলা খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রকৃতি। এবার তার জীবনে আরেকটা পরিবর্তন প্রয়োজন। রাজ দরবার থেকে কোথাও তাকে সরে পড়তে হবে।
সেই শিশুটি যখন বৃদ্ধা হয় তখন ভাগ্যক্রমে নিজের পরিবারের নাম ঠিকানা এবং অতীত ইতিহাস জানতে পারে, আর সেই সব ব্যবস্থাই করে দেয় নিয়তি। তখন সেই বৃদ্ধা নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখালে মহারাজা তাকে প্রচুর ধনরত্ন অর্থ কড়ি রাজকীয় বাহন দিয়ে নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। এরপরই সেই নারী নিজ গ্রামে এসে বাস করা শুরু করে কিন্তু ততক্ষণে গ্রামময় রটে গেছে এক বাঈজী এসেছে গ্রামে আর তাতে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে চারদিকে।
তখন সেই নারী আত্বশুদ্ধির পথ খোজতে থাকে। তিনি তার অতীত জীবনের জন্যে অনুতপ্ত হতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার মনে হয় তিনি যদি এলাকায় একটি মসজিদ তৈরী করে দেন তাহলে হয়তো আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে পারেন।
এলাকায় শুরু হয় মসজিদ নির্মাণ কাজ, ঠিক হয় কবে কখন শুরু হবে প্রথম নামাজ। নিয়োগ হয় ইমাম মোয়াজ্জিন কিন্তু সেই সাথে কিছু মানুষ শুরু করল প্রতিবাদ। বাঈজীর টাকায় এলাকায় কোন মসজিদ চলতে পারবেনা আর অন্যদিকে একটা পক্ষ দাড়াল এই বলে যে, সে আগে যাই করুক এখন তো আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছে। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল তিনি ক্ষমা করতেও পারেন।
এভাবেই একদিন প্রথম আজান হল সেই মসজিদে। আর সেই আজানের শব্দ শুনে দলে দলে বিরোধীরা এসে হামলা করল মসজিদে আর তাতে প্রথম নামাজের দিন থেকেই পরিত্যক্ত হল মসজিদটি। সেই থেকে আজও পরিত্যক্ত পড়ে আছে সেটি। ঘটনার পর রাগে কষ্টে সেই অনুতপ্ত নারী আর কোনদিন বাড়ির বাহির হননি। ঘরে বসে প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চেয়েছেন। এভাবেই চোখের জলে চিরবিদায় হয় সেই দুঃখিনী নারীর। আজীবন যাকে নিয়ে খেলেছে প্রকৃতি। যে সমাজ তার ক্ষমাপ্রার্থনার পথকে পায়ের তলায় পিষ্ট করেছিল সেই সমাজ তার মৃত্যুর পরও শেষ বিদায় নিয়ে শুরু করল বাদ প্রতিবাদ।
লৌকিক বিচারে হয়তো সেই মসজিদ ঘৃণার বিষয় কিন্তু ক্ষমাশীল আল্লাহ তার অনুশোচনা ক্ষমা প্রার্থনা কবুল করবেন কিনা তা নিষ্চিত নয় কেহই এমনকি যারা আজও ঘৃণাভরে মসজিদটি প্রত্যাক্ষান করেন তারাও আর যারা যুগে যুগে বিরোধিতা করেছেন তারাও তাই হয়তো এত বিতর্কিত হয়ে আজও কেউ মসজিদটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাননি। সব স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেললেও বাঈজীর টাকায় কেনা আর গেথে যাওয়া সেই জড়াজীর্ণ ইটের গাথুনী ঠিকই অক্ষত রেখেছে সবাই তাই ইতিহাসের করুন সাক্ষী হয়ে প্রায় দুই শ বছর ধরে এক অসহায় নারীর করুন আর্তনাদ হয়ে টিকে আছে বাইজীর মসজিদ।
লেখকঃ গিয়াসউদ্দীন একরাম