কুমিল্লার সানফ্লওয়ার ও সানলাইফ বিজনেস: গ্রাহকদের কোটি টাকা আত্মসাৎ
কুমিল্লায় সানফ্লওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এবং সানলাইফ বিজনেস লিঃ নামে বরুড়া উপজেলায় ৮টি শাখা অফিস ও চান্দিনা উপজেলার ২টি শাখা অফিসের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে সানলাইফ বিজনেস লি: এর চেয়ারম্যান ও সানফ্লওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শাহাদাৎ হোসেন এবং সানফ্লওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সানলাইফ বিজনেস লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবুল কালামের বিরুদ্ধে। এই দুই মাল্টিপারপাসের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে অনেকের সংসার ভেঙ্গেছে। আবার কয়েকজনের আত্মহত্যা করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। আবার অনেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে পথের ভিখারি হয়েছেন। এসব বিষয়ে সর্বশান্ত হওয়া মানুষেরা লিখিত অভিযোগ করেছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে।
অভিযুক্ত মো: শাহাদাৎ হোসেন কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার পেরপেটি গ্রামের মিজানুর রহমানের ছেলে।বর্তমানে তিনি মহানগরীর জাঙ্গালিয়া এলাকার জে এস টাওয়ারের ৬ষ্ঠ তলায় বসবাস করছেন। অপর অভিযুক্ত মোঃ আবুল কালাম কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার শাকপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে। তিনি মহানগরীর জাঙ্গালিয়া এলাকার জে এস টাওয়ারের ৫ম তলায় বসবাস করছেন।
লিখিত অভিযোগ ও স্থানীয় অসংখ্য মানুষের সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত শাহাদাৎ হোসেন ও আবুল কালাম বরুড়া উপজেলায় এক আতংকের নাম যারা, অর্থ আত্মসাৎকারী হিসাবে চিহ্নিত। ২০০৫ সালে শাহাদাৎ হোসেন এবং ২০০৬ সালে আবুল কালাম বরুড়া উপজেলার ছাত্র শিবিরের সভাপতি ছিলেন। সেই সময় ২০০৬ সাল হতে ২০১২ সাল পর্যন্ত সানফ্লওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এবং সানলাইফ বিজনেস লিঃ নামে বরুড়া উপজেলায় ৮টি শাখা অফিস ও চান্দিনা উপজেলায় ২টি শাখা অফিসের মাধ্যমে সমাজের অতি সহজ, সরল, নিরীহ, প্রবাসীদের স্ত্রী, অবসর প্রাপ্ত চাকুরীজীবি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, কৃষকের দীর্ঘদিনের অর্জিত অর্থসহ নানান শ্রেণি পেশার ব্যক্তি বর্গ থেকে অধিক সুদের প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় শতশত কোটি টাকা। তাছাড়া তারা গ্রাহকদের সুদের দ্বিগুণ, তিনগুণ ও চারগুণসহ বিভিন্ন স্কিম চালু করে অর্থ আত্মসাৎ করে, অনেকে আবার অতি লোভে পড়ে জমি বিক্রি করে, বাড়ি বিক্রি করে এমন বসতভিটা পর্যন্ত বিক্রি করে এই দুই মাল্টিপারপাসকে টাকা দিয়ে সর্বশান্ত হয়। তারা আরো অভিনব কায়দায় আনন্দ দেয়ার মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকার জন্য প্রলুব্ধ করতে সঙ্গীত শিল্পী মনির খানসহ দেশের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ব্যান্ড সঙ্গীতের আয়োজনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে।
এভাবে তারা গ্রাহকদের থেকে সব টাকা আত্মসাৎ করে ২০১২ সাল থেকে গাঁ ঢাকা দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। আর তখন সর্বস্ব হারিয়ে শতশত গ্রাহকের আর্তনাদে বরুড়ার ইতিহাসে এক কলংকিত অধ্যায় সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে আশাহত গ্রাহকরা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দিনের পর দিন তাদের খুজঁতে থাকে। এরই মধ্যে অনেক প্রবাসীদের স্ত্রী তালাকপ্রাপ্ত হয়, টাকা না পেয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে, অনেকে টাকার জন্য চিকিৎসা করতে না পেরে মারা যায়। এক সময় বেঁচে থাকা আশাহত শতশত গ্রাহকেরা দীর্ঘদিন টাকা না পেয়ে আশা ছেড়ে দেয়। তখন অভিযুক্ত পক্ষ শাহাদাৎ হোসেন ও আবুল কালাম সুযোগ বুঝে ২০১৮ সালে কুমিল্লা শহরে গোপনে অবস্থান নেয়। এরই মধ্যে তারা নামে, বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আবারো চালু করে। তখন তারা আবারও বরুড়া যাওয়ার পায়তারা করে। তারা বরুড়ার কিছু সুবিধাভোগী,স্থানীয় প্রভাবশালী এবং দালাল চক্রের মাধ্যমে আশাহত গ্রাহকদের বলে দেশের ব্যবসা পরিস্থিতি ভাল ছিল না বিধায় তখন তারা আত্মগোপনে ছিল। তারা গ্রাহকদের কিছুটা দিতে আশ্বস্থ করে। দীর্ঘদিন টাকা না পেয়ে আশাহত গ্রাহকরা মনে করে যা পাই তাই নেই। এই সুযোগে তারা বলে পূর্বে মূল টাকার বিপরীতে যে সুদ তোমরা নিয়েছো এখণ মূল টাকা থেকে তা কর্তন করা হবে এবং যা অবশিষ্ট থাকবে তা জমির সাথে সমন্বয় করা হবে। তখন গ্রাহকরা পরিস্থিতির স্বীকার এবং বাধ্য হয়ে জমি নিতে চাইলে তারা বর্তমান মূল্যের ৪/৫ গুণ নির্ধারণ করে। দেখা যায় যে বর্তমানে ১ লক্ষ টাকা মূল্যের শতক জমি ৪/৫ লক্ষ টাকা করে তারা মূল্য নির্ধারণ করে। তারপরও অসহায় দিশেহারা দিকভ্রান্ত গ্রাহকরা কিছুটা পাওয়ায় আশায় মেনে নিতে রাজি হয়। কিন্তু তারপরও গ্রাহকদের সাথে তারা প্রতারণা করে জমির রেজিঃ খরচ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত থাকলেও রেজিঃ খরচ কয়েকগুণ নির্ধারণ করে। রেজিঃ খরচের টাকা অগ্রিম নিয়ে নেয়। কিন্তু অগ্রিম টাকা নিয়ে সামান্য কিছু গ্রাহককে অধিক মূল্যের জমি সমন্বয় করলেও প্রায় গ্রাহককেই রেজিঃ খরচ নিয়ে আবার নতুন করে প্রতারিত করে। এভাবেই তারা আজও দিনের পর দিন ধোকায় ফেলে গ্রাহকদের জর্জরিত করছে।
একাধিক সূত্র আরো জানায়, তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও কুমিল্লাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। ঢাকার বাড্ডায় কবরস্থান সংলগ্ন ১৯ কাঠা জমি, ঢাকা ইত্তেফাক মোড় সংলগ্ন ৪ কাঠা বাড়ি, কক্সবাজার কলাতলী ডলফিন চত্ত্বরে সাইদী টেডার্স নামে ১৯ শতক জমি, কুমিল্লা জাঙ্গালিয়ায় জেএস টাওয়ার (১০ তলা ভবন), আশ্রাফপুর সানফ্লাওয়ার টাওয়ার (৯ তলা ভবন বেপজা স্কুলের সাথে), কান্দিরপাড় জাহাঙ্গীর জমজম টাওয়ার, কুমিল্লা চান্দিনার বিশ্বরোড সংলগ্ন ৪০ শতক জমিসহ নামে বেনামে বহুস্থানে তারা সম্পদের পাহাড় গোপনে পুঞ্জিভূত করে রেখেছে।
বরুড়ার বাসিন্দা মোবারক হোসেন জানান, ২০০৬ সালে ৫ লাখ টাকা আমি সানফ্লওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এ এফডিআর করি। ২০১২ সালে তারা গ্রাহকদের টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর এখন ২০২১ সাল চলছে। আমি টাকা ফেরত পাইনি। আমার মত অনেকের টাকা তারা আত্মসাৎ করে এখন বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা করছে।কিন্তু অসংখ্য মানুষ নি:স্ব হয়ে পথে ঘুরছে এখন।
বরুড়ার চন্ডীপুর গ্রামের বাসিন্দা সামছুল হক জানান, আমি সানফ্লওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে ১ লাখ টাকা রেখেছিলাম। এই টাকা এখনো পাইনি ।আমরা গেলে কোন পাত্তা পাই না।
আরো জানা যায় অভিযুক্ত পক্ষের আবুল কালামকে সবাই সুদ কালাম হিসাবে চিনে, সে একজন হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও আজ কোটি কোটি টাকা আর সম্পদের মালিক। অভিযুক্ত পক্ষ শাহাদাৎ হোসেন রাষ্ট্র বিরোধী ও জ্বালাও পোড়াও মামলার আসামী। বর্তমানে মামলা চলমান।
এ বিষয়ে জানতে মোঃ শাহাদাৎ হোসেন ও মোঃ আবুল কালামের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে মুঠোফোন সংযোগে তাদের পাওয়া যায়নি।