কুমিল্লা বিমানবন্দর ৪৪ বছর ধরে নিষ্প্রাণ
ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝামাঝি এবং ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা কুমিল্লা। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রবাসীর সংখ্যা এ জেলায়। এখানে রয়েছেন প্রায় ১৫ লাখ প্রবাসী। রেমিট্যান্সেও সর্বোচ্চ কুমিল্লা জেলা। ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা জেলার বিমানবন্দরটি বন্ধ রয়েছে গত ৪৪ বছর (মাঝে দুই সপ্তাহ বাদ দিয়ে) ধরে।
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেউরা-ঢুলিপাড়ার পাশে স্থাপিত হয় কুমিল্লা বিমানবন্দর। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে সেনাবাহিনীরা এ বিমানবন্দর ব্যবহার করতেন। ওই বছর থেকে বন্দরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বিমান ওঠানামা করে এ বন্দরে। এরপর যাত্রী সঙ্কটের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় ১৯৯৪ সালে আবার বিমানবন্দরটি চালু করা হলেও তেমন যাত্রী না হওয়ায় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এয়ারলাইনসগুলো বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেয়। মূলত দেশের অভ্যন্তরের ফ্লাইটগুলো চালু ছিল এ বন্দরে।
কুমিল্লা বিমানবন্দর এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ৭৭ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিমানবন্দরের অধিকাংশ এলাকায় ঘাস চাষ করা হয়েছে। এছাড়া বন্দরের ভূমিতে রয়েছে ছোট ছোট পুকুর। কুমিল্লা ইপিজেডের ৩ নম্বর গেট রয়েছে কুমিল্লা বিমানবন্দর এলাকায়। এর আশেপাশে আছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশেনের নেউরা, ঢুলিপাড়া, রাজাপাড়া, উনাইসার, দিশাবন্দ ও রসুলপুর এলাকা।
বিমানবন্দরের জন্য নির্মিত রাস্তা অবস্থিত ঢুলিপাড়া, রসুলপুর ও রাজাপাড়ার একাংশে। যাত্রী ওঠানামার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এ রাস্তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান, মাত্র ৩০ কোটি টাকার সংস্কারে বিমানবন্দরটি সচল হতে পারে। চালু হলে বিমানবন্দর সংলগ্ন কুমিল্লা ইপিজেডে আরও অনেক বিদেশি বিনিয়োগ আসতো, কর্মসংস্থান হতো বিপুল সংখ্যক মানুষের। কুমিল্লার অর্থনীতিতে যোগ হতো নতুন মাত্রা।
বিমানবন্দরটি এখন আন্তর্জাতিক রুটের সিগন্যালিংয়ের কাজ করে। প্রতিদিনই ৩৫ থেকে ৪০টি বিমান এই সিগন্যাল ব্যবহার করে। বেশি চলাচল করে ভারতে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমান। আগরতলা বিমানবন্দরে যাওয়া বিমান এই রুটে চলে। এছাড়া রয়েছে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরের বিমান। এ বিমান বন্দর প্রতিমাসে সিগন্যালিং বাবদ আয় করছে ৩০-৪০ লাখ টাকা। বিমান বন্দরটি চালু করতে বেশি অর্থের প্রয়োজন নেই। বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে।
জমি কেনা বা অধিগ্রহণের ঝামেলা নেই। প্রয়োজন রানওয়ে কার্পেটিং, ফায়ার সার্ভিস ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের জনবল। বর্তমানে এ বন্দরে ২০ জন লোকবল রয়েছে।
কুমিল্লা ইপিজেড ব্যবসায়ীদের মতে, বিমানবন্দর চালু হলে কুমিল্লা ইপিজেডে আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী আসতো, কর্মসংস্থান হতো বিপুল সংখ্যক মানুষের। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যাতায়াতে কুমিল্লা বিমান বন্দর চালু করা জরুরি।
এদিকে, দীর্ঘদিন কুমিল্লা বিমানবন্দরে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকায় ক্ষুব্ধ কুমিল্লার প্রবাসীরা। বিমানবন্দর থাকা সত্ত্বেও এর কার্যক্রম অসম্পূর্ণ থাকায় ফেসবুকে নিয়মিত ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে কুমিল্লার মানুষ।
মো. মিজানুর রহমান নামে এক ওমান প্রবাসী বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে আসা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। কুমিল্লার প্রবাসীর সংখ্যা সারাদেশের তুলনায় বেশি। এছাড়া পর্যটনেও সমৃদ্ধ কুমিল্লা জেলা। আমরা কুমিল্লায় বিমানবন্দরকে সক্রিয় করার জোর দাবি জানাই।’
বাহরাইন প্রবাসী জাফর আহমেদ বলেন, ‘এখন করোনার দুঃসময়। আমরা প্রবাসীরা বিদেশ যাওয়ার মাত্র দুদিন আগে নমুনা জমা দিই। একদিন পর ফল আসে। মাঝেমাঝে বিদেশ যাওয়ার দিনও নমুনার ফল আসতে শুনেছি। এ সময় করোনার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বিদেশ যাওয়া কঠিন ব্যাপার। কুমিল্লার বন্দরটিতে বিমান ওঠানামা করলে দুশ্চিন্তা থাকতো না।’
কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদ পারভেজ খান ইমরান বলেন, ‘বিমান বন্দর সংলগ্ন ইপিজেডে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বিমান চলাচল এখন সময়ের দাবি। এছাড়া বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লার সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রবাসে অবস্থান করছে। তাদের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলে চাহিদা রয়েছে।’
কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল হাসনাত বাবুল বলেন, ‘ঢাকারও আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুমিল্লা বিমান বন্দর চালু হয়। মাঝে বিমান বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পিছিয়ে গেছে কুমিল্লা।’
কুমিল্লা বিমান বন্দরের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবদুল গণি বলেন, ‘বিমানবন্দরটির বেশিরভাগ জিনিস সচল। ২০-২৫ কোটি টাকা খরচ করলে এ বন্দরটিতে বিমান ওঠানামার কাজ শুরু করা যাবে। আমরা ঊর্ধ্বতন মহলে কথা বলেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় কুমিল্লায় তেমন যাত্রী না হওয়াতে এয়ারলাইনসগুলো বিমান চালাতে অনীহা প্রকাশ করে। এখন কুমিল্লার প্রচুর যাত্রী। পাশেই আছে কুমিল্লা ইপিজেড। বন্দরটি পুনরায় চালু করতে পারলে কুমিল্লার অর্থনীতিও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াত।’
আবদুল গণি বলেন, ‘সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক যখন বিমান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন, তখন এ বিমানবন্দর চালুর বিষয়ে জোর চেষ্টা করেছেন। এরপর আর কেউ তেমন সদিচ্ছা প্রকাশ করেননি। এ বন্দরটি চালুর বিষয়ে কুমিল্লার রাজনীতিকরা যদি আন্তরিক হন, তবেই তা আলোর মুখ দেখবে বলে আমি মনে করি।’
সাবেক রেলপথ মন্ত্রী ও কুমিল্লা-১১ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, ‘বিমানবন্দরটি চালু করার জন্য একটা সময় আমি কথা বলেছি। এখন মহাসড়ক ফোরলেন হওয়াতে যাতায়াতে সময় কমে এসেছে। আমার ধারণা, সরকার সময়ের কথা চিন্তা করে বন্দরটি পুনরায় চালু করছে না।’