কুমিল্লা চিড়িয়াখানার অধিকাংশ খাঁচাই শূন্য !
অধিকাংশ খাঁচা শূন্য পড়ে আছে কুমিল্লা চিড়িয়াখানার। আছে অবকাঠামোগত নানা সমস্যা। তাই এটা এখন অনেকটা নামেই চিড়িয়াখানা। বর্তমানে জায়গাটি যেন মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপের ‘নিরাপদ’ আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাই বিনোদনের এই জায়গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কুমিল্লাবাসী।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে কুমিল্লা শহরের কালিয়াজুরি মৌজায় ১০ দশমিক ১৫ একর জায়গা নিয়ে চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠিত হয়। চিড়িয়াখানা করা হয় দশমিক ৭৫ একর জায়গাজুড়ে। বর্তমানে সেখানে ২৯টি পশুপাখি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি চিত্রা হরিণ, একটি ময়ূর, ৮টি বিভিন্ন প্রজাতির বানর, দুটি বাজপাখি, চারটি মেছো বাঘ, একটি অজগর, দুটি খরগোশ, একটি কালাম পাখি, তিনটি তিতি পাখি ও তিনটি ঘোড়া।
এর আগেও এখানে ছিল চিত্রা হরিণের পাল, শিয়াল, তিনটি ময়ূর এবং এক মাত্র সিংহ ‘যুবরাজ’। এগুলো এখন আর নেই। তাই সাধারণ মানুষ এখন আর কুমিল্লা চিড়িয়াখানায় পশুপাখি দেখতে যায় না।
কুমিল্লা জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী কিশোর কুমার দেবরায় জানান, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ২৫ লাখ টাকায় চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন ইজারা দেয়া হয়। ইজারাদার পশুপাখির খাদ্য দিচ্ছেন। একই সঙ্গে পরিচর্যাও করা হচ্ছে।
গত ৮ মে সকালে সরেজমিন দেখা যায়, চিড়িয়াখানার অধিকাংশ খাঁচা খালি। সিংহের খাঁচাটি দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে। ময়ূরের খাঁচার ভেতরে কাঠের গুঁড়ি রাখা হয়েছে। যে কয়টি পশুপাখি আছে, সেগুলোও আছে অযত্ন-অবহেলায়। চিড়িয়াখানার পূর্ব ও উত্তর পাশের সীমানাপ্রাচীর একেবারেই নিচু। এই প্রাচীর ডিঙিয়ে শিশু-কিশোররা ওঠানামা করে। লকডাউনের কারণে নীরব চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন।
এদিকে চিড়িয়াখানা সংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনেরও বেহাল দশা। সেখানকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছের গোড়া থেকে মাটি সরে গেছে। অযত্ন আর অবহেলায় মরে যাচ্ছে গাছ। নতুন করে কোনো গাছ লাগানো হচ্ছে না। বৃষ্টি হলেই পানিতে সড়ক তলিয়ে যায়। সড়কের দুই পাশ জঙ্গলে ভরে গেছে। সব মিলিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি দেখতে যেন একটি ভুতুড়ে জায়গায় পরিণত হয়েছে।
অপরদিকে দর্শনার্থীদের জন্য শৌচাগার থাকলেও নেই পানির সুব্যবস্থা। পুকুর থেকে পানি নিয়ে শৌচ কাজ সারতে হয় দর্শনার্থীদের। মাঝে মাঝে পানির পাত্রটিও উধাও হয়ে যায়। এতে দর্শনার্থীদের বিপাকে পড়তে হয়। এছাড়া নেই খাওয়ার পানির ব্যবস্থাও। ইজারাদারের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বার বার জানানো হলেও কোনো কাজই হয়নি।
কুমিল্লা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের ইজারাদার আনিছুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালে ইজারা নেয়ার পর থেকে চিড়িয়াখানার উন্নয়নের জন্য প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে চিড়িয়াখানার সীমানা প্রাচীর উঁচুকরণ, চিড়িয়াখানার প্রবেশদ্বারে মাটি ভরাট, পানকৌড়ি এলাকায় গ্রিল লাগানো, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুর চিড়িয়াখানা থেকে বাঘ, ভালুক, হরিণ, ময়ূর ও অন্যান্য পশুপাখি আনা এবং পশুচিকিৎসক নিয়োগ দেয়া। এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি কর্তৃপক্ষ, যার ফলে দর্শনার্থী কমে গেছে। এতে গত তিন বছরে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। যেটা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
কুমিল্লার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী বলেন, কুমিল্লা চিড়িয়াখানা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। নেই পশুপাখি, যার ফলে দর্শনার্থীরা আর সেখানে যায় না। কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারকির মাধ্যমে এটা হয়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় এক দিগন্ত। তাই এটাকে অবহেলা না করে সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মী খায়রুল আনাম রায়হান বলেন, সঠিক তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কুমিল্লা চিড়িয়াখানার আজ বেহাল দশা। বর্তমানে এটা মাদক ও অসামাজিক কাজের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পুরনো এই বিনোদন কেন্দ্র ইজারা না দিয়ে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করলে, এটি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রশাসক রিয়ার এডমিরাল (অব.) আবু তাহের বলেন, চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের জায়গার মালিক জেলা প্রশাসন। জেলা পরিষদ এটি তদারকি করে থাকে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য পরিষদের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এটা পাস হলে বোটানিক্যাল গার্ডেনকে আধুনিকায়ন করা হবে। তবে চিড়িয়াখানার নিয়ে আপাতত আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন নিয়ে আমাদের এককভাবে কিছুই করার নেই। জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ সম্মিলিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।