কুমিল্লার তানভীর যেভাবে মিডলসেক্সের সেরা কোচ
চাইলে লর্ডসের বিখ্যাত লং রুমে নিজের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারবেন আপনি। হোম ড্রেসিংরুম ঘুরে আসার ব্যবস্থাও আছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেটের বিখ্যাত এ ভেন্যুর ওল্ড প্যাভিলিয়নের এ অভিজ্ঞতা নিতে গেলে পয়সা গুনতে হবে। তবে ৭ সেপ্টেম্বর তানভীর আহামেদ যখন লর্ডসের হোম ড্রেসিংরুমে গিয়ে ফেসবুক লাইভে গেলেন, তখন তাঁর হাতে একটা স্মারক। একটু পর লং রুমের ডাইনিং থেকে ভিডিও কলে যে আয়োজন দেখালেন, সেটি অনেকটা তাঁকে ঘিরেই। মিডলসেক্স ক্রিকেটের এ বছরের সেরা কোচের পুরস্কার জিতেছেন ‘বাংলাদেশি’ তানভীর। সৌজন্য টিকিট নিয়ে কদিন আগেও দ্য হানড্রেডে লন্ডন স্পিরিট ও ম্যানচেস্টার অরিজিনালসের খেলা দেখে এসেছেন, কিন্তু এবার লর্ডসে তাঁর যাওয়ার কারণটি ছিল একেবারেই আলাদা।
কুমিল্লার ছেলে তানভীর ২০০৯ সালে যখন দেশ ছাড়েন, উদ্দেশ্য ছিল পড়াশোনা। সেটি করেছেনও। বিএ করেছেন, এরপর এমবিএর সঙ্গে এমএসসিও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি লিগে খেলতেন। এখনো লিগে খেলেন, তবে নিজের ভাষায় তিনি ‘গড়পড়তা’ ক্রিকেটার। মাস্টার্স শেষ করার পর সেখানকার আরেক বাংলাদেশি কোচ শহীদুল আলমের পরামর্শে ঢুকে পড়েন কোচিংয়ে। তানভীর এখনো খেলেন, আম্পায়ারিং করেন, স্কোরার, গ্রাউন্ডসম্যানের কোর্সও করেছেন। তবে তাঁর এখন সবচেয়ে বড় পরিচয় ওই কোচ হিসেবেই।
মিডলসেক্সের সেরা কোচের পুরস্কার পাচ্ছেন, এমন ই-মেইল পাওয়ার পর গত মাসে তানভীর প্রথম আলোকে বলছিলেন তাঁর শুরুর গল্পটা, ‘খেলতাম ভালোই, তবে খুব ভালো তো নয়। দলে টিকে থাকতে পারফর্ম করতে হতো নিয়মিত। পরে সে দলের অধিনায়কও হই। কোচ হিসেবে যখন এলাম, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লাম এখানেও। স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াতাম বাচ্চা আনতে। ডিভিশন থ্রিয়ের একটা ক্লাব নিয়ে শুরু করেছিলাম। মানুষের কাছে কথাও শুনতে হয়েছে এ ক্লাব দেওয়ার সময়।’
লন্ডনের যে অংশে থাকেন তানভীর, এমনিতেও সেখানে দক্ষিণ এশিয়ান কমিউনিটি খুব একটা বড় নয়। স্বাভাবিকভাবেই ‘মানিয়ে নেওয়ার’ বড় একটা ব্যাপার ছিল তাঁর, ‘নিজেকে অসহায় মনে হতো, আমার তো তেমন যোগাযোগ নেই এ লাইনে।’ সেই তানভীর এখন অনূর্ধ্ব-১২ থেকে অনূর্ধ্ব-২১ পর্যন্ত নিজেই ১৩টি দলকে কোচিং করান। সঙ্গে আছে সাবেক ইংল্যান্ড পেসার সাজিদ মাহমুদের একাডেমি, যেখানে তাঁর সঙ্গে কাজ করেন আরেক সাবেক ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান ওয়াইস শাহও। তানভীর বলেন, ‘এখন ১৫০-এর ওপর বাচ্চা আছে আমার অধীন। তবে প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার জনকে ক্রিকেট শেখাই—স্কুল, প্রোগ্রাম, ফাংশন সব মিলিয়ে।’
গ্রীষ্মে তানভীরের এখন তাই ঠাসা সূচি। তাঁর ভাষায়, ‘শনিবার, রবিবার নিজে খেলি। সোম থেকে শুক্র বাচ্চাদের খেলা থাকে, আমার ক্লাবের হয়ে আম্পায়ারিং করতে হয়। মৌসুমে প্রতিটি বয়সভিত্তিক দলের ১৫টির বেশি করে ম্যাচ থাকে। এরপর আবার কারও বিশেষ চাহিদা থাকে, বিশেষ সেশন করাতে হয়। কারও হয়তো সামনে আঞ্চলিক কোনো ট্রায়াল আছে, তাকে নিয়ে কাজ করতে হয়।’
স্নাতকোত্তরের পর তানভীরের ইচ্ছা ছিল পিএইচডি করবেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রপোজাল গ্রহণও করা হয়েছিল। সেটি শেষ পর্যন্ত করা হয়ে ওঠেনি ক্রিকেট কোচিংয়ের কারণেই। পিএইচডি না হোক, আপাতত তাঁর লক্ষ্য কোচিংয়ে লেভেল থ্রি শেষ করা। সর্বশেষ নিজের কাউন্টি থেকে একমাত্র কোচ হিসেবে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের হয়ে লেভেল থ্রি করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে অ্যাডভান্স লেভেলের কোর্স শেষ করেছেন, সামনে নিজের পেপার সাবমিট করার অপেক্ষায় তানভীর।
মিডলসেক্সের এবার সেরা কোচের পুরস্কার তানভীরের ওসব কাজেরই স্বীকৃতি বলে মনে করেন তিনি, ‘গত বছরও এ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, মনোনয়ন পেয়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পাইনি। এবারও যখন তারা আবেদন জমা দিতে বলল, আসলে আত্মবিশ্বাস ছিল। যে পরিমাণে খেলোয়াড় ডেভলপ করার কাজ করি।’
সামনে ইসিবির জাতীয় পর্যায়ে সেরা কোচের পুরস্কারের জন্যও মিডলসেক্স মনোনীত করতে যাচ্ছে তাঁকে।
সম্প্রতি কোনো বাংলাদেশি বা বাঙালি এমন পুরস্কার পেয়েছেন বলে জানেন না তানভীর। সর্বশেষ ১২ বছর আগে মনোনয়ন পেয়েছিলেন শহীদুলই, যাঁর হাত ধরেই কোচিংয়ে আসা তানভীরের। শহীদুল সেবার পুরস্কারটি জেতেননি, তবে ‘শিষ্যে’র প্রাপ্তিতেই খুশি তিনি। তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঘিরেও শুধু কোচিংই, ‘লেভেল থ্রি হয়ে গেলে লেভেল ফোরের চেষ্টা করব। এখন তো মাইনর কাউন্টিতে কাজ করছি, সামনে মেজর কাউন্টিতে যাওয়ার ইচ্ছা। মিডলসেক্স, ওয়ারউইকশায়ার থেকে অফারও পেয়েছি, তবে এখন একটা বয়সভিত্তিক দলের দায়িত্ব দেবে শুধু। কিন্তু নিজে এখন কয়েকটা গ্রুপকে নিয়ে কাজ করতে পারছি, “জুনিয়র”থেকে “অ্যাডাল্ট” করতে পারছি। আমার তাদের সবাইকে নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে, বিশেষ করে অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে অনূর্ধ্ব-২১ পর্যায়ে। তরুণেরাই তো শক্তি দেশের জন্য, কমিনিউটির জন্য। আমি মনে করি, কোচ যদি বন্ধুর মতো হতে পারে, তাহলে প্রতিটা খেলায় যেকোনো কিছু করা সম্ভব। আর এখানে মেয়েদের ক্রিকেট নিয়েও কাজ করতে পারছি, সামনেই আমার একটা মেয়ে মিডলসেক্সে ট্রায়াল দেবে।’
ইংল্যান্ডে কোচিংয়ে এমন নাম করলেও দেশে তেমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই তাঁর। ২০১৬ সালে সর্বশেষ দেশে এসেছিলেন, মাঝে মা মারা গেলেও করোনাভাইরাসের কারণে আসতে পারেননি। তবে দেশে ফেরার ইচ্ছাটা আছে, ‘লেভেল থ্রি করে নিই, আরেকটু অভিজ্ঞতা হোক। সুযোগ থাকলে নিশ্চয়ই দেশেও কাজ করব।’
বাবার পুলিশের চাকরির সুবাদে বাংলাদেশে তানভীর থেকেছেন বেশ কয়েকটি জায়গায়। শেষ পর্যন্ত এইচএসসি পড়তে ঢাকায় আসেন। কলাবাগান, ধানমণ্ডিতে অনুশীলন করতেন, ‘৮ নম্বর মাঠে বিকেলে যেতাম, যদি বোলিংয়ের সুযোগ পাই।’
সেই তানভীর এখনো নেটে যান। তবে শিখতে নয়, শেখাতে।
সূত্রঃ প্রথম আলো