কুমিল্লায় ডিপিইও কাণ্ডে ১৩ হাজার শিক্ষকের ঘুম হারাম!
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো নির্দেশনা নেই। অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। পুরোটাই নিজের একক সিদ্ধান্ত। পঠন দক্ষতা যাচাইয়ের নামে কুমিল্লার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩ হাজার শিক্ষককে পরীক্ষার টেবিলে বসাচ্ছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) মো. আব্দুল মান্নান। এরই মধ্যে শেষ করা হয়েছে সব আয়োজন। আগামী ১০ নভেম্বর থেকে শিক্ষকদের এই যোগ্যতার পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ।
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা এমন কোনো নির্দেশনা দেয়নি। অতি উৎসাহী হয়ে এমনটা করলে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষকদের মান যাচাইয়ের পরীক্ষা নিতে ডিপিইও আব্দুল মান্নান প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইন্সট্রাক্টরদের নিয়ে একটি কমিটি করেছেন। এ পরীক্ষার ইনভিজিলেটর হিসেবে থাকবেন জেলার বিভিন্ন বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা।
স্কুল খোলার দিনে পূর্ণ কর্ম দিবসে শ্রেণি কার্যক্রম বাদ দিয়ে সব শিক্ষক পরীক্ষা দিতে গেলে ওই দিনের যে শ্রেণি কার্যক্রম তার কী হবে? শুধু শিক্ষক নন, অনেক কর্মকর্তাও ডিপিইওর এই সিদ্ধান্তকে হাস্যকর বলেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষকরা জানান, চাকরির শেষ বয়সে এসে অনেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে তাঁর মেধার মান যাচাই করতে পরীক্ষায় বসতে হবে, এটা তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। এ পরীক্ষার মাধ্যমে ডিপিইও তাঁদের অপমান করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও মত দিয়েছেন অধিকাংশ শিক্ষক। শিক্ষকরা বলছেন, তাঁরা সরকারের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হয়েই নিয়োগ পেয়েছেন। চাকরিতে আসার পর ১৮ মাস সিইনএড ও ডিপিএড প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করেছেন। অনেকে এই পরীক্ষা আয়োজনকে ডিপিইওর হঠকারী সিদ্ধান্ত বলেও উল্ল্নেখ করেন। তবে চাকরির ভয়ে কুমিল্লার শিক্ষকরা নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিদায়ী সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান শিক্ষকদের নিজ নিজ শ্রেণির পাঠদানের বিষয়টি ভালোভাবে পড়ার জন্য অনুরোধ জানান। এরপর কুমিল্লার ডিপিইও তাঁর জেলার শিক্ষকদের প্রাথমিকের বইগুলোর ওপর পরীক্ষা নেওয়ার আয়োজন করেন। জানা যায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩২টি পাঠ্যবই রয়েছে। এই ৩২টি বই পড়ে তার মান যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
কুমিল্লার বুড়িচংয়ের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমার চাকরি আছে আর ছয় মাস। এখন আমাকে যোগ্যতা প্রমাণ করে চাকরি করতে হবে, এটা আমার জন্য আত্মহত্যার শামিল।’
কুমিল্লা মহানগরের আরেক শিক্ষক বলেন, ‘আমি আমার স্টাফদের সঙ্গে মিটিং করেছি, ডিপিইও স্যারের নির্দেশে যদি আমাদের পরীক্ষায় বসতে হয়, তাহলে আমরা সাদা খাতা জমা দিয়ে আসব। জানি, এর জন্য উনি হয়রানি করবেন। তবে এভাবে প্রতিবাদ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
পাশের জেলা চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও কোয়াকোর্ট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ওমর খৈয়াম বাগদাদী রুমী বলেন, শ্রেণিতে পাঠদানের জন্য বিষয়গুলো শিক্ষকরা অবশ্যই পড়েন এবং সে অনুসারে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করেন। তবে এর জন্য শিক্ষকদের পরীক্ষা দিতে হবে কেন?
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, শিক্ষকরা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। নতুন করে মেধার মান যাচাইয়ের সুযোগ নেই। কোনো বিষয়ে কোনো শিক্ষকের শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় ঘাটতি থাকলে তা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাধান করা যায়, যা ইউআরসিতে শিক্ষকরা নিয়মিত করছেন। মান যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা নেওয়া শিক্ষকদের অপমানের শামিল। আমরা এই পরীক্ষা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি।
শিক্ষকদের পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে ডিপিইও আব্দুল মান্নান বলেন, এটাকে আমি পরীক্ষা বলব না, এটা হচ্ছে শ্রেণিওয়ারি বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক পঠন ও মানযাচাই অভীক্ষা। সরকার যখন বই দেয়, তখন দুই সেট করে অতিরিক্ত বই দেওয়া হয়, যেন সংশ্নিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক আগে পড়ে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে পাঠদান করতে পারেন। ‘হঠাৎ শুধু কুমিল্লায় কেন এমন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষকদের বই পড়ার সিদ্ধান্ত আগেরই। তবে তাঁদের মূল্যায়ন করতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে বাধা কোথায়? তাছাড়া দেশের কোথাও না থাকলে এমন মূল্যায়ন কুমিল্লায় করা যাবে না, এমন তো হতে পারে না। তিনি এ পরীক্ষা নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, আগামী ১০ নভেম্বর থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে কুমিল্লার প্রতিটি উপজেলার ক্লাস্টার এমনকি সাব-ক্লাস্টার পর্যায়ে এমসিকিউ ৫০ নম্বরের এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আলাদা দিনে পরীক্ষা হবে, তাই প্রশ্নও হবে ভিন্ন ভিন্ন।
সূত্রঃ সমকাল