কুমিল্লা সদরে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেননি ৩১ শিক্ষক
ভোগান্তি ও অনিয়ম বন্ধের লক্ষ্যে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলিতে অনলাইন সিস্টেম চালু করে সরকার। এ পদ্ধতিতে সারা দেশে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছেন বদলি হওয়া শিক্ষকরা। কিন্তু কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলায় বদলি হওয়া ৩১ সহকারী শিক্ষক নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে পারছেন না। এই শিক্ষকরা বদলির অফিস আদেশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে গেলে উপজেলা শিক্ষা অফিসার তাদের যোগদান করাতে অপারগতা জানান। জেলা শিক্ষা অফিসারও নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানান। পরামর্শ দেন- স্থানীয় (কুমিল্লা-৬) এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এমপি নতুন করে বদলি হয়ে আসা শিক্ষকদের যোগদান করাতে নিষেধ করেছেন। এদিকে ৩১ শিক্ষকের অধিকাংশই পূর্বের কর্মস্থল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নেয়ায় বন্ধ রয়েছে তাদের বেতন ভাতাও।
বদলি হওয়া শিক্ষকদের অধিকাংশই নারী। যারা বৈবাহিক সূত্রে এখন কুমিল্লা সদর এলাকার বাসিন্দা। এদের বেশির ভাগই ইতোমধ্যে নিজেদের ভোটার আইডি কার্ড করেছেন। যেখানে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে স্বামীর ঠিকানা ব্যবহার করেছেন।
এ ছাড়াও কয়েকজন স্বামীর কর্মস্থল সূত্রে কুমিল্লা সদরে বদলি হয়েছেন। স্বামী/স্ত্রীর কর্মস্থল সূত্রে ১০ শতাংশের বেশি বদলি হওয়ার সুযোগ নেই। তবে স্বামীর স্থায়ী ঠিকানায় ফেরার ক্ষেত্রে এ কোটা প্রযোজ্য নয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘সমন্বিত অনলাইন বদলি নির্দেশিকা (সংশোধিত) ২০২২’ এর ৩.৯-এ বলা আছে- ‘চাকরি লাভের পূর্বে এবং চাকরি লাভের পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এমন শিক্ষক স্বামী/স্ত্রীর স্থায়ী ঠিকানায় বদলি হতে ইচ্ছুক হলে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শূন্য পদের বিপরীতে বদলি করা যাবে।
এ ধরনের বদলির ক্ষেত্রে বিবাহের সময় স্বামী/স্ত্রীর যে স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ওই ঠিকানায় বদলির ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৩.৮-এ বর্ণিত ১০% কোটা পূরণের শর্তটি প্রযোজ্য হবে না।’ যদিও এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের দাবি- নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ১০ শতাংশের বেশি বদলি হয়ে আসতে পারবেন না। সেটা যেই হোক না কেন। তাই তিনি বহিরাগত কাউকে এলাকায় যোগদান করতে দিতে পারেন না। আর ভুক্তভোগী শিক্ষকদের দাবি- তারা বদলি হওয়া প্রতিষ্ঠানে যোগদানের লক্ষ্যে স্বামীর স্থায়ী ঠিকানার সপক্ষে প্রয়োজনীয় সব নথি জমা দিয়েছেন। এরপরও তাদের পদায়ন করা হচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ভুক্তভোগী শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপিও দেন। যেখানে সদর উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিতকরণে সরকারপ্রধানের সহযোগিতা চাওয়া হয়। অনলাইনে বদলি প্রক্রিয়াকে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ উল্লেখ করে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে না পারার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও জেলা শিক্ষা অফিসারকে দায়ী করেন তারা। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়- স্থানীয় এমপির আপত্তির বিষয়টিও। এ ছাড়া ছাড়পত্র নিয়ে নেয়ার কারণে বেতন ভাতা বন্ধ হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানান শিক্ষকরা। তাই বিষয়টির সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা সদরের সৈয়দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হওয়া ইসরাত জাহান জুহি বলেন, আমি বদলির আদেশসহ বৈধ সব কাগজপত্র দেখানোর পরও জয়েন করতে পারছি না। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন- এমপি মহোদয়ের নিষেধ আছে। সারা দেশে সবাই এ পদ্ধতিতে বদলি হলেও আমরা এখানে পারছি না। একটি উপজেলার জন্যতো সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। আমরা বিষয়টির সমাধান চাই। কুষ্টিয়ার জগন্নাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কুমিল্লা সদরের শালধর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হওয়া সেলিনা আক্তার বলেন, সরকার অনলাইন বদলি সিস্টেম করেছে ভোগান্তি কমানোর জন্য।
কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ভোগান্তি বেড়েছে। আমি পুরাতন কর্মস্থল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নিয়েছি। কিন্তু নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছি না। এখানকার সংশ্লিষ্ট কর্মমর্তারা বলছেন- এমপি মহোদয়ের অনুমতি নেই। তারা বলেন, লোকাল এমপি’র সঙ্গে আপস করতে। আমাদের এখন বেতন ভাতা বন্ধ। ছেলেদেরও স্কুল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নিয়েছিলাম। এখন তারাও পড়ালেখা থেকে দূরে রয়েছে। মানবেতর জীবনযাপন করছি। মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত আমরা। আমি ব্যক্তিগতভাবে একাধিকবার গিয়েছি এমপির সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান না।
কুমিল্লা জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মান্নান বলেন, অফিস আদেশ অনুযায়ী অনলাইনে যারা বদলি হয়ে এসেছে তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে দিতে হবে। কিন্তু স্থানীয় এমপি চান না বাইর থেকে কেউ এসে এখানে চাকরি করুক। তিনি এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটারও দিয়েছেন। বদলি হয়ে আসাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগদান করানোর দায়িত্ব উপজেলা শিক্ষা অফিসারের। কিন্তু তিনি এমপিকে ডিঙিয়ে এ কাজটি করতে পারবেন না। রাজনৈতিক একটি বিষয়তো থাকে যেটি সবার জানা। আমরা এখানে আজ আছি কাল নেই। আমি যদি টিওকে নির্দেশনা দিই তারপর সে যদি লাঞ্ছিত হয় তার দায় কে নেবে। এখানে কার চাকরি হলো না হলো সেটাতো আমাদের বিষয় না। ২০১৯ সালেও তিনি যোগদান করতে দেননি। আমি বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। অনুরোধ করেছি- ডিজি, সচিব, মন্ত্রী যেন এমপি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তারা আমাকে অধিদপ্তরের নির্দেশনা পালন করতে বলেছেন। তখন- আমি বলেছিলাম শেল্টার দেন। এমপিকে বাইপাস করে কিছু করা কঠিন।
জানতে চাইলে কুমিল্লা-৬ আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, যারা এ শিক্ষকদের বদলি করেছেন তারা আইন বহির্ভূতভাবে করেছেন। কর্মকর্তারা ভুল করেছেন। ২০২৩ সালের আইন অনুযায়ী ১০ শতাংশের বেশি বদলি হয়ে আসতে পারবে না। কিন্তু আমার এখানে সেটি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত অতিক্রম করেছে। যার কারণে এলাকার ছেলে-মেয়েরা চাকরি পায় না। আমি আমার এলাকার মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করি। মানুষ আমাকে ভোট দেয় তাদের কাজ করার জন্য। প্রাথমিকের কোনো শিক্ষকের সঙ্গে আমার বিরোধ নেই। যারা এতগুলো বদলি করেছেন তারা অন্যায়ভাবে করেছেন। পয়সাকড়ি খেয়ে করেছেন। আমার এলাকার ছেলে-মেয়েরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে পাস করেও চাকরি পায় না কোটার কারণে। সবাই আমার এখানে বদলি হয়ে আসলেতো এখানে শূন্যপদ তৈরি হবে না। আর শূন্যপদ তৈরি না হলে নিয়োগ হবে না। নিয়োগ হবে অন্য এলাকায়। আমার এলাকার ছেলে-মেয়েদের কী হবে? আমি ইতোমধ্যে ডিও লেটার দিয়েছি। মন্ত্রীর সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহমেদ বলেন, এটা আমাদের নজরে এসেছে। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিষয়টি সমাধান করতে বলেছি। তিনি ইতোমধ্যে জেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের জয়েন করাতে বলা হয়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
সূত্রঃ মানবজমিন