কুমিল্লা নগরীতে ‘বিমান’ আতঙ্কে স্থানীয়রা
কুমিল্লার নগরী এখন পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে। মৃত্যু নিশ্চিত না হলেও পঙ্গুত্ববরণ নিশ্চিত হচ্ছে অনেক যাত্রী ও পথচারীর। আর এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে ‘বিমান’। শুনতে অবাক লাগলেও এই আতঙ্কে রয়েছে কুমিল্লাবাসী। কুমিল্লার বিভিন্ন সড়কে দাপিয়ে চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মিশুক। স্থানীয়রা এসব যানকে বিমান নামেই ডাকেন। অতিরিক্ত গতি ও চালকদের অনভিজ্ঞতার কারণেই এই নাম দিয়েছেন তারা।
একদিকে চালকদের নেই কোনও প্রশিক্ষণ কিংবা সনদ। অন্যদিকে সড়কে ঝুঁকি তৈরি করা এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মিশুকের নেই কোনও অনুমতিপত্র। আর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনও জানে না এসব যানবাহনের প্রকৃত সংখ্যা। কীভাবে সড়কে এসব যান চলছে, কে-ইবা এর নেপথ্যে, জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে এমন নানা প্রশ্ন। তবে এত গতির বিষয়টি জানা গেছে চালকদের কাছ থেকে।
কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা, গাড়ির চালক ও যাত্রী, ফুটপাতের ব্যবসায়ী এবং ট্রাফিক পুলিশের সূত্রে জানা গেছে, বেপরোয়াভাবে কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে অটোরিকশা ও মিশুক। বিদ্যুৎ-চালিত এসব যানবাহনের চালকদের নেই কোনও প্রশিক্ষণ। চালাতে চালাতে শিখবেন, এমন চিন্তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কুমিল্লায় আসেন তারা।
অটোরিকশার সংখ্যা জানে না কেউ
কুমিল্লা শহরের গণপরিবহন বলতেই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মিশুক। তাই যাতায়াতের একমাত্র উপায় এসব যানবাহন। বিশেষ করে যারা প্রতিনিয়ত ছেলে-মেয়েদের নিয়ে স্কুল ও কলেজ এবং বৃদ্ধ ও অসুস্থদের নিয়ে চলাফেরা করেন। কিন্তু যাচ্ছেতাইভাবে চলা এসব যানকে নিয়ন্ত্রণে শুধু উদ্যোগই নেওয়া হয়, বাস্তবায়ন নেই বলে অভিযোগ কুমিল্লা নগরবাসীর। এসবের সংখ্যাও সরকারি বা বেসরকারি কোনও সংগঠনের কাছে নেই।
তবে ট্রাফিক পুলিশের সূত্র বলছে, কুমিল্লা নগরীতে প্রতিদিন চলাচল করে অন্তত ২৫ হাজারের বেশি অটোরিকশা ও মিশুক। আবার এর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
বেপরোয়া গতির কারণ
চালক, যাত্রী, ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, এসব অটোরিকশা ও মিশুকের মালিকরা সিন্ডিকেট করে চলেন। একজন চালককে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আবার কখনও ৬০০ টাকা পর্যন্ত গাড়ির জমা দিতে হয়। মালিকদের ইচ্ছাই শেষ কথা। তাই জিম্মি হয়ে চালক এসব চালাতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন বয়সী অন্তত ২০ জন চালকের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের।
কুমিল্লা শহরতলির ধর্মপুর এলাকার এক চালক জানান, ধর্মপুর এলাকায় সর্বোচ্চ ভাড়া ১০ টাকা। মালিককে দৈনিক জমা দিতে হয় ৫০০ টাকা। তারপর সংসারের জন্য আয় করতে হয়। দিনে ৫০০ টাকা জোগাড় করা কতটা কষ্টের তা কেউ বোঝে না। এই অবস্থায় কোনও চালক আছে যে ধীরে গাড়ি চালাবে? তাই দ্রুতগতিতে চালিয়ে বেশি ভাড়া মারা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই।
নগরীর শুভপুর এলাকার আরেক চালক বলেন, বাইরে থেকে যারা আসে, তাদের কারণেই মূলত বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। তারা খালি রাস্তা পেলেই জোরে টান দেয়। গতিতে গাড়ি চালানোর আরেকটি কারণ নিজের দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ করা। এদের বেশির ভাগই তরুণ। তারাই দুর্ঘটনা ঘটায়।
তিনি আরও বলেন, যখন কোনও তরুণী বা কম বয়সী নারী গাড়িতে উঠে বসেন, তখন তারা বিভিন্ন কায়দায় এদিক-ওদিক দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাড়ি চালায়, যা খুবই ভয়ানক। এসব তরুণ চালকের অত্যন্ত গতিতে গাড়ি চালানোয় আমরা বিপদে পড়ি।
নগরের শাসনগাছা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, আরেক হাতে সিগারেট। এসব লোকের কাছে আপনি কীভাবে নিরাপদ যাত্রা প্রত্যাশা করবেন? তাদের গাড়িতে কোনও মিটার নেই! কোন স্থান থেকে কোন স্থানের দূরত্ব কত, কোন জায়গায় এলে কত গতিতে গাড়ি চালাতে হবে বা কোন স্থানে কীভাবে গাড়ি চালাতে হবে, তারা কিছুই বোঝে না। এদের কাছে জীবনের কোনও মূল্য নেই।
প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা
কুমিল্লার ট্রাফিক পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৯ জুলাই নগরে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের এটিএসআই ইলিয়াস হোসেনকে একটি অটোরিকশা বেপরোয়া গতিতে এসে আঘাত করে। এতে তার ডান হাত ভেঙে যায়। এখনও তিনি কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১০ জুলাই পুলিশের এক কনস্টেবল সড়কে আহত হন।
সূত্র আরও বলছে, কোনও উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হলে পুলিশ চেষ্টা করেও এসব দুর্ঘটনা ও অপেশাদার চালকদের থামানো যাবে না। এসব চালক সড়কে পুলিশ দেখলে গতি কমায়। প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদস্যরাও আহত হন। কিন্তু পুরো রাস্তায় তো পুলিশ পাহারা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি কুমিল্লা শহরে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন কুমিল্লার স্থানীয় দুই সংবাদকর্মী। গত ৩০ মে অটোরিকশায় চড়ে দুর্ঘটনার শিকার হন বৈশাখী টিভির কুমিল্লার স্টাফ রিপোর্টার আনোয়ার হোসেন। তার পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় একাধিকবার তাকে নেওয়া হয়েছে ঢাকায়। এখন তিনি বেড রেস্টে আছেন।
গত ৬ জুলাই অটোরিকশায় করে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন যমুনা টিভির ক্যামেরাপারসন কামরুল হাসান। গুরুতর আহত হয়ে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। বর্তমানে বেড রেস্টে আছেন।
কামরুল হাসান জানান, অটোরিকশাটি যে চালাচ্ছিল, তার বয়স ১৪ থেকে ১৫। পুরোপুরি অদক্ষ চালকের কারণে কোনও কারণ ছাড়াই দুর্ঘটনা ঘটে, যার ভুক্তভোগী হই আমরা। প্রশাসনের নজিরদারি বাড়ালে এসব চালক আর নগরীতে ঢুকতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনাও কমবে।
এদিকে কুমিল্লার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য ক্লিনিকের তথ্যে জানা গেছে, প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। কিন্তু ঝামেলা মনে করে চিকিৎসার আগে বা পরে তেমন কেউই অভিযোগ করেন না।
যানজটের অপর নাম কুমিল্লা শহর
অবৈধ এসব যানের কারণে কুমিল্লা শহরের প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে দীর্ঘক্ষণ লেগে থাকে যানজট। এসব যানজটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ ভয়ংকরভাবে অটোরিকশা চালানো।
ট্রাফিক পুলিশ বলছে, কুমিল্লা নাগরীতে প্রায় ২৫ হাজার অটোরিকশা ও মিশুক আছে, যা নগরীর প্রতিটি সড়ক-উপসড়ক ও অলিগলি দখল করে রাখে। ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি পরিবহন হওয়ায় যানজটে নাকাল হয়ে যায় কুমিল্লা শহরবাসী। বিশেষ করে অফিস ও স্কুল ছুটির সময় নগরের প্রতিটি মোড়েই যানজট তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে লেগে থাকে এই যানজট। এ ছাড়া ট্রাফিক আইন অমান্য করে উল্টো পথে চলে এসব পরিবহন। স্ট্যান্ড ছাড়াই দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী ওঠানো-নামানো ও প্রতিযোগিতামূলকভাবে চালানোয় দুর্ভোগ কমে না এই শহরে।
অবৈধ অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ
ট্রাফিক পুলিশের সূত্র বলছে, গত বছর কোটি টাকার ওপর জরিমানার অর্থ সরকারি খাতে জমা দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। সেখানে মামলা জরিমানা ও বিভিন্ন ব্যবস্থার কথা উল্লেখ রয়েছে।
কুমিল্লার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জিয়াউল হক টিপু বলেন, আমরা নিয়মিত মামলা ও ব্যবস্থা নিচ্ছি। সিটি করপোরেশন থেকেও এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদি ওই উদ্যোগের বাস্তবায়ন হয়, তবে শিগগিরই আমাদের এসব কাজের সুবিধা হবে। আমরা চেষ্টা করছি যানবাহন নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ দিতে। আমরা নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ করে ঈদ পূজা ও বড় কোনও অনুষ্ঠান হলে নগরীতে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য নিয়োগ করি। তা ছাড়া বিভিন্ন সড়কে ডিভাইডার লাগানো হয়েছে। এসব চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কুমিল্লা টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি কাজী এনামুল হক ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই দুর্ভোগ কমাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমরা জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে কয়েক দিন আগেও সংবাদ প্রকাশ করেছি। পরিকল্পনা ছাড়া শুধু উদ্যোগ গ্রহণ করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ সমস্যার ভুক্তভোগী হচ্ছেন কুমিল্লা নগরীর মানুষ। তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা এসব অবৈধ অটোরিকশার চালক ও মালিকদের লাগাম টেনে ধরতে সিটি করপোরেশনের মেয়র, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করছি।
তিনি আরও বলেন, কয়েক দিন আগে আমার স্ত্রী বাচ্ছাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় মাথায় আঘাত পেয়েছেন। এসব অটোরিকশা এখন সবার কাছে আতঙ্ক। তা ছাড়া এগুলো সরকারি বিদ্যুতের অপচয় করছে। আর যানজটের প্রধান কারণও এসব অটোরিকশা। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে এখন কোনও লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। তাই অটোরিকশা ও মিশুকের সংখ্যা আসলে কত, তা বলা সম্ভব নয়। তবে পরিকল্পনায় আছে। শিগগিরই অটোরিকশা ও মিশুকসহ সব পরিবহনকে লাইসেন্সের আয়ওতায় আনা হবে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম বলেন, আমি এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র আরফানুল হক রিফাত বলেন, আমি কুমিল্লারই ছেলে। কুমিল্লার সমস্যা আমরা আগেই ধরতে পেরেছি। আমরা যানজটের জন্য এক বছর সময় নিয়েছি। এ নিয়ে কাজ করছি। আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই ফলাফল পাবেন। অটোরিকশা ও মিশুকের সংখ্যাও নির্ধারণ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।