কুমিল্লার পর্যটন খাতে থামছে না ক্যামেরা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য
দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে ফিরে স্ত্রী নিয়ে ঘুরতে এসেছেন আকরাম। এ সময় কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে এক কিশোর জিজ্ঞেস করেন, ‘ছবি তুলবেন?’ কয়েকবার নিষেধ করার পর কিশোরের অনুরোধে ১০০ টাকায় ২০টি ছবি তুলতে রাজি হন। পরে পাঁচটি কর্নারে ৭৫০ ছবি তুলে সেই পরিমাণ টাকা দাবি করে কিশোর। আকরাম ছবি নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। কেন ছবি নেবেন না, এমনটা হুমকি দিয়েই আকরামকে মারধর শুরু করে কয়েকজন ক্যামেরাম্যান।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার পর্যটন নগরী কোটবাড়ির সংরক্ষিত শালবন বিহারে এমন ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার পর আকরামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভারেল্লা ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দা। দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে ফিরে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যান কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকার শালবন বিহারে। সেখানে প্রবেশের পর ক্যামেরা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েন তিনি।
তিনি আরও জানান, একজন ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাশে থাকা আরও দুজন ক্যামারাম্যান এসে আকরামকে ঘিরে ধরেন। ভীত আকরাম ছবি প্রয়োজন নেই; তবে ২০০ টাকা দেওয়ার কথা বললেও, কেন ছবি নেবেন না বলেই তাকে এলোপাতাড়ি মেরে আহত করে চক্রটি। এ সময় তাদের সঙ্গে ভেতরে থাকা এক আইসক্রিম বিক্রেতাও আকরামকে মারধর করে।
আকরাম বলেন, তারা আমাকে হুমকি দেয় আমি বের হলেই আমাকে মারবে। তারপর পর্যটন পুলিশের সহায়তায় আমি কোটবাড়ি এলাকা থেকে বের হই। আমি পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে। সংরক্ষিত এলাকায় এভাবে যদি পর্যটকদের ওপর হামলা করা হয়, তাহলে মানুষ কেন যাবে সেখানে?
আকরামের মতো হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকার সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে আসেন। এসেই স্থানীয় এই ক্যামেরা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েন। অনেক পর্যটক তাদের সর্বস্ব হারিয়ে ভ্রমণের আনন্দের বদলে দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
সূত্র বলছে, সপ্তম থেকে বারোশ শতকের বিভিন্ন স্থাপনা দেখতে কুমিল্লাসহ সারা দেশ থেকে পর্যটকরা আসেন কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায়। যে কারণে সম্ভাবনার দেখা মিলছিল কুমিল্লার পর্যটন শিল্পে। দিন দিন বাড়ছিল পর্যটন খাতের আয়। কিন্তু সম্প্রতি কুমিল্লার পর্যটন নগরীতে এক আতঙ্কের দেখা মিলেছে। যে আতঙ্কে আতঙ্কিত খোদ পর্যটন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। এই আতঙ্কের নাম ক্যামেরা আতঙ্ক। কুমিল্লার পর্যটনে যা বর্তমানে হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কুমিল্লার পর্যটন আগ্রহের স্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কুমিল্লার কোটবাড়ির শালবন বিহার, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, ময়নামতি জাদুঘর ও পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধবিহার (মন্দির)। এ ছাড়া বেসরকারি অনেক রিসোর্ট ও পার্ক এই জেলায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে।
যাদের টার্গেট করা হয়
স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যটকদের পর্যটন কেন্দ্রে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই টার্গেট করে চক্রটি। গলায় ক্যামেরা ঝোলানো আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘোরাফেরা করা এই সিন্ডিকেটের টার্গেট ভ্রমণে আসা তরুণ-তরুণী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা পর্যটক ও বিশেষ করে নারী পর্যটক।
যেভাবে ফাঁদে ফেলা হয়
সূত্র বলছে, ক্যামেরা চক্রের উৎপাত বেড়েছে দেড় বছর ধরে। এর আগে এসব সমস্যার সম্মুখীন হননি কেউ। পর্যটক, স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই চক্রটি পর্যটকদের টার্গেট করে ছবি তুলে দেবে বলে প্রলোভন দেখায়। এ সময় তারা নামমাত্র মূল্যে ছবি তোলার কথা বলে। কিন্তু অতিরিক্ত ছবি তোলার পর অতিরিক্ত মূল্য দাবি করে। সুযোগ পেলে তরুণ-তরুণীদের ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েও টাকা আদায় করা হয়। প্রায়ই প্রতি ছবি পাঁচ টাকা বললেও, পরে সুন্দর ছবি উঠেছে বলে ১০ টাকা দাবি করা হয়। এতে প্রতি ছবির দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। যে কারণে বিড়ম্বনায় পড়েন পর্যটকরা। আর মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কুমিল্লার এসব পর্যটন এলাকা থেকে।
ঘুরতে আসা পর্যটক মুনমুন বলেন, তারা ১০০ টাকার নিচে ছবি তোলে না। অনেক সময় জোর করেই ছবি তোলা হয়। যতক্ষণ আপনি ছবি না তুলবেন আপনার পিছু ছাড়বে না। আগে সময় পেলেই আসতাম। কিন্তু এখন মন চায় না আসতে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কুমিল্লার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, গত সপ্তাহে ক্যামেরা চক্রের সদস্যরা ঘুরতে আসা এক পর্যটককে মেরে আহত করে। এ সময় তারা দলবল নিয়ে আবার তাকে মারার জন্য যায়। পরে বিহারের লোকজন দেখে তাদের উদ্ধার করেন। স্থানীয় এ চক্রটি বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের জন্য আমরাও বিপাকে আছি।
সংরক্ষিত এলাকায় কীভাবে তাদের প্রবেশ
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থেকে ঘুরতে আসা পর্যটন আলী আশরাফ বলেন, এভাবে সংরক্ষিত এলাকায় যদি পর্যটকরা অনিরাপদ থাকেন, তাহলে মানুষ এখানে আর আসবে না। আস্তে আস্তে জৌলুশ হারাবে এই পর্যটন কেন্দ্র। আমি দেখেছি, তারা দেয়াল টপকে ভেতরে আসে। আবার অনেকে গেট দিয়েও আসে। তবে মাস্ক পরিহিত থাকে তারা। এটা নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সূত্র বলছে, শালবন বিহারসহ প্রায় সব কটি স্থানেই ৫ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এই চক্রটি স্থানীয় হওয়ায় রাতের বেলায় বিভিন্ন জায়গায় দেয়ালের গ্রিল কেটে দিনে যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা করে রাখে। এতে তাদের দেখতে পান না নিরাপত্তা প্রহরীরা। আবার অনেক সময় ব্যাগের ভেতর ক্যামেরা নিয়ে মুখে মাস্ক পরে প্রবেশের ফলে কেউ টেরি পান না। যখনই প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তারা ও দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা ভেতরে প্রবেশ করেন তারা বৈদিকভাবে খবর পেয়ে যায় এবং নিজেরা গা ঢাকা দেয়। এভাবেই নিজেদের সতর্ক অবস্থানে রাখে চক্রটি।
তাদের থামানো যাচ্ছে না কেন
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চক্রটি কুমিল্লার পর্যটন নগরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের আটকানো যাচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নে কুমিল্লার শালবন বিহারের দায়িত্বে থাকা ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান কুমিল্লা মো. শাহীন আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত মাসে আমি দায়িত্ব পেয়েছি। এরপরেই দুটি ঘটনা ঘটে গেলো। আমি যখন এসেছি, তখনই তাদের তীব্র উৎপাত দেখেছি। একজন পর্যটককে মারা আর তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার গায়ে হাত দেওয়ার সমান। বিষয়টি নিয়ে আমি আসার পর একাধিক মিটিং করেছি। তাদের কোনোভাবেই থামাতে পারছি না। গতকালও (সোমবার) আমি মিটিং করেছি। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসারদের সরাসরি বলে দিয়েছি যেন এ ব্যাপারে কঠোর হয়। ট্যুরিস্ট পুলিশের সঙ্গেও কথা হয়েছে আমার। তাদের বলেছি শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে।
তিনি আরও জানান, পর্যটকদের অধিকতর নিরাপত্তার জন্য জাদুঘর ও শালবন বিহারের বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সিসি ক্যামেরার পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। জাদুঘরে নিয়োজিত ব্যাটালিয়ন আনসারদের সাদাপোশাকে জাদুঘর ও শালবন বিহারে টহল বৃদ্ধির জন্য ব্যাটালিয়ন আনসারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পরিদর্শক দীপক কুমার দাশ বলেন, আমি একটি অভিযোগ মোবাইলে পেয়েছি। তাৎক্ষণিক পুলিশ সদস্যদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য সংখ্যা খুবই কম। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি যেন কোন পর্যটক সমস্যার সম্মুখীন না হন। আমরা কোটবাড়ি অঞ্চলে টহল বাড়িয়ে দেব।
কুমিল্লা জাদুঘর ও শালবন বিহারের আনসার ব্যাটালিয়ন প্লাটুন কমান্ডার দেলোয়ার হোসেন বলেন, আগের কর্মকর্তা থাকার সময় থেকে তাদের উৎপাত বেশি। তারা স্থানীয় শক্তিশালী চক্র। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছি। আমাদের দায়িত্ব মূলত জাদুঘরে। ২০১৫ সাল থেকে আনসার ব্যাটালিয়ন জাদুঘর ও শালবন বিহারের গেটের দায়িত্বে থাকে। এরপরও সোমবারের মিটিংয়ে আমাদের শালবন বিহারের দায়িত্বও পালনের কথা জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আগামীকাল থেকে কঠোরভাবে শালবন বিহারের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছি। দুজন অতিরিক্ত লোকবল শালবন বিহারে থাকতে বলেছি। একজন সাদাপোশাকে, আরেকজন পোশাকে।