চাকরি ফিরে পেলেন কুমিল্লার সেই ইমাম, ‘সরি’ বললেন ইউএনও

চাকরি হারানোর ৫১ ঘণ্টা পর অবশেষে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে চাকরি ফিরে পেয়েছেন কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ভাটরা কাছারী কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা আবুল বাশার।

আজ রবিবার মাগরিবের নামাজ থেকে তিনি মসজিদে ইমামতি শুরু করেছেন। চাকরি ফিরে পাওয়ার পর প্রথম ওয়াক্তে (মাগরিব) তার পেছনে নামাজ আদায় করেছেন সেই লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফোরকান এলাহি অনুপম। সন্ধ্যায় ওই মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ পারভেজ হোসেন ও ইমামের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গত শুক্রবার খুতবা শেষে জুমার নামাজ শুরুর আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) একটু সরে দাঁড়াতে বলাকে কেন্দ্র করে ওই মসজিদের ইমামকে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া এ ঘটনায় ওই ইউএনও ক্ষুব্ধ হয়ে একাধিকবার সেই ইমামকে মসজিদের পুকুরের পানিতে চুবানোর হুমকি দেন। বিষয়টি জানাজানি হলে সর্বপ্রথম ঘটনাটি নিয়ে শনিবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে নামাজের সময় ইউএনওকে সরে দাঁড়াতে বলায় চাকরি হারালেন ইমাম! শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ’র অনলাইন সংস্করণ। এরপর খবরটি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ আজ রবিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার কার্যালয়ে যান ইউএনওর তোপের মুখে পড়া সেই ইমাম। এ সময় সেখানে উপস্থিত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বডুয়া, লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফোরকান এলাহি অনুপম, জেলা ইসলামী ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন, স্থানীয় পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুল্লাহ, স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার গোলাপ হোসেন, মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ক্বারি আবদুর রশিদ, সেক্রেটারি জহিরুল ইসলামসহ, কেন্দ্রীয় ও জেলার আলেমগণ।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইমাম ও মুয়াজ্জিন ঘটনার পুরো বিবরণ দেন। ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য শুনে জেলা প্রশাসক ইউএনওকে ইমামের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে বলেন।

এ সময় ইউএনও সরি বলে ওই ইমামের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইমামকে নিজের মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না বলে আশ্বস্ত করেন।

কুমিল্লা জেলা ইমাম সমিতির সভাপতি হাফেজ মিজানুর রহমান বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে লালমাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ইমামের ঘটনাটি সমাধান হয়েছে। জেলা প্রশাসক মহোদয় অদ্য (রবিবার) মাগরিব থেকে ইমামকে নামাজ পড়াতে বলেছেন এবং কেউ হুমকি-ধমকি দিলে জেলা প্রশাসককে অবহিত করতে বলেছেন। সমাধানের পর ইউএনও নিজের গাড়িতে করে ইমামকে নিয়ে ওই মসজিদে গেছেন।

মসজিদের ইমাম মাওলানা আবুল বাশার বলেন, ‘নামাজ শুরুর আগে ইমামের পেছনে মুয়াজ্জিন থাকে। তখন পেছনে অন্য একজনকে দেখে একটু সরতে বলি। পরে জানতে পারলাম উনি ইউএনও। তখন আমি ওনার কাছে সরি বলি। পরে উনি আমাকে পুকুরে চোবাবেন বলছেন। এরপর স্থানীয় একজন চেয়ারম্যান ও ইউএনও স্যার তাঁর পাঠানো লোকের বরাত দিয়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি জানান। এ বিষয়টি নিয়ে রবিবার বিকেলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আমাদের নিয়ে বসা হয়। ইউএনও বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পরে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে আমি মসজিদে ইমামতিতে যোগদান করি। আমি ডিসি স্যারের তাৎক্ষণিক এমন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট।’

ঢাকা থেকে এসে বিষয়টি নিয়ে তৎপর হওয়া শানে শাহাবা খতিব কাউন্সিল বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মুফতি শামীম মজুমদার বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে বিষয়টি জেনে আমরা কুমিল্লায় আসি। তখন জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্নজনের সাথে কথা বলেছি। জেলা প্রশাসক ইমাম ও ইউএনওর সাথে বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছেন। ইউএনও এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে দুজনে কোলাকুলি করেছেন।’

কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘ইমাম ও ইউএনওর মধ্যে একটি ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। জেলা প্রশাসক বিষয়টি নিয়ে ইমাম, ইউএনও, স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং ইমামদের নেতৃবৃন্দ ও মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দ নিয়ে বসে সমাধান করে দেন। ইমাম ওই মসজিদে স্বপদে বহাল থাকবেন। জেলা প্রশাসন সব সময় ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের পাশে থাকবে।’

এর আগে গত ১৩ অক্টোবর (শুক্রবার) ভাটরা কাছারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজের সময় সামনের সারিতে ইমামের বরাবর (মুয়াজ্জিনের স্থানে) শার্ট-প্যান্ট পরে বসা অবস্থায় না চিনতে পেরে ইমাম ও মুয়াজ্জিন লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরতে বলেছিলেন। এর জেরে নামাজের পর ইউএনও ইমাম-মুয়াজ্জিনকে মসজিদের দক্ষিণ পাশের সরকারি পুকুরের পাড়ে নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা বিভিন্ন প্রশ্ন করেন ও বকাবকি করেন। ইউএনও উত্তেজিত হয়ে ইমামকে একাধিকবার পানিতে চুবাতে বলেছেন। একপর্যায়ে ইউএনওর সাথে উপস্থিত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মসজিদের একজন মুসল্লিকে দিয়ে ইমামকে পরদিন থেকে মসজিদে আসতে নিষেধ করেন। ওই দিন জুমার পর থেকে ইমাম আর মসজিদে আসেননি।

আরো পড়ুন