শিক্ষক সংকটে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি বিভাগের মধ্যে অন্যতম একটি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। এই বিভাগের আটজন শিক্ষকের মধ্যে চারজন শিক্ষা ও একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। বাকি তিনজন শিক্ষক নিয়ে চলছে বিভাগটির কার্যক্রম।

একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি ১৭ বিভাগেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ব্যতীত সব বিভাগেরই একাধিখ শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। ফলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মত অন্যান্য বিভাগগুলো স্বল্প শিক্ষক নিয়ে কোনোমতে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ২৬৬ জন শিক্ষকের মধ্যে শিক্ষা ছুটিতে আছেন ৯৩ জন। এর মধ্যে গণিত বিভাগে ১৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ছয়জন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ১৬ জনের মধ্যে আটজন, পরিসংখ্যান বিভাগের ১৪ জনের মধ্যে পাঁচজন, রসায়ন বিভাগে ১৫ জনের মধ্যে নয়জন, ফার্মাসি বিভাগের ১৩ জনের মধ্যে ছয়জন, ইংরেজি বিভাগে ১৭ জনের মধ্যে সাতজন, বাংলা বিভাগের ১৪ জনের মধ্যে দুইজন, ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের ১৫ জনের মধ্যে দুইজন শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন।

এছাড়া একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ১৬ জন শিক্ষকের মধ্যে চারজন, মার্কেটিং বিভাগের ১৫ জনের মধ্যে পাঁচজন, ফিনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের নয়জনের মধ্যে তিনজন, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৩ জনের মধ্যে নয়জন, আইসিটি বিভাগের ১৩ জনের মধ্যে পাঁচজন, লোকপ্রশাসন বিভাগের ১৮জনের মধ্যে পাঁচজন, অর্থনীতি বিভাগের ১৭ জনের মধ্যে চারজন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৭ জনের মধ্যে ছয়জন, প্রত্নতত্ব বিভাগের ১১ জনের মধ্যে তিনজন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আটজনের মধ্যে চারজন শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। এছাড়া সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষক রয়েছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে।

শিক্ষা ছুটিতে থাকা শিক্ষকের বিপরীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্বব্যাপী উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। কিন্তু ইউজিসির ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কুবিতে ৬ হাজার ৩৮৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ২৬৬ জন শিক্ষক রয়েছে। যা অনুপাত হিসাবে ১:২৪।

এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় টিচিং লোড ক্যালকুলেশন নীতিমালা (সাধারণ) ২০২২ মতে, একজন শিক্ষকের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৪০ হবে। এই কর্মঘণ্টা কন্ট্রাক্ট আওয়ার এবং নন-কন্ট্রাক্ট আওয়ার সমন্বয়ে পরিপূর্ণ হবে। ৪০ ঘন্টার মধ্যে একজন শিক্ষক গড়ে ১৩ ঘন্টা ব্যয় করবেন কন্টাক্ট আওয়ার হিসাবে। কিন্তু বিভাগ/ইনস্টিটিউটের প্রধানের সাপ্তাহিক কন্টাক্ট আওয়ার ৬ ঘন্টা হবে।

কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট থাকায় কর্মে নিয়োজিত থাকা শিক্ষকদের টিচিং লোড পড়ছে অতিরিক্ত। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অনেক শিক্ষক একাধিক কোর্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় অল্প ক্লাস নিয়েই দ্রুত শেষ করছেন সিলেবাস। ফলে সিলেবাস অনুযায়ি পাঠ্যসূচি শেষ হলেও অজানাই থেকে যাচ্ছে অনেক বিষয়।

এ বিষয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ছুটির বিষয়ে নির্ধারিত বিধি থাকলেও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। ফলে শিক্ষক সংকটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এছাড়া কর্মস্থলে থাকা অন্যান্য শিক্ষকদের উপর চাপ বেশি পড়ছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমস্যা। শিক্ষা ছুটির জন্য আলাদা নিয়ম তৈরি এবং ইউজিসি থেকে নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রুত এই সমস্যা সমাধান করা উচিত।’

রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. একেএম রায়হান উদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রসাশনের কাছে বিভাগের জন্য শিক্ষক নিয়োগ চেয়েছি। কিন্তু ইউজিসি পদ না দেওয়ায় প্রশাসন কোনো নিয়োগ দিতে পারছে না। ইউজিসি থেকে পদ পেলে শিক্ষক সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষার জন্য অনেক শিক্ষক ভালো স্কলারশিপ পেয়ে থাকেন। বিভাগ থেকেও সুপারিশ যায়। তখন শিক্ষক সংকটের কথা বলে সুপারিশ না দিলে শিক্ষকের মধ্যেও এক ধরনের ক্ষোভ কাজ করে। কাজ করতে চায় না। প্রশাসন কিংবা আমাদের কারোই উপায় নেই। এখন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দরকার সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য।’

প্রকৌশল অনুষদের ডিন ও কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান মাহমুদুল হাসান রাজু বলেন, ‘আমাদের বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এই শিক্ষক সংকট কাটাতে আমাদের বিভাগে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি করছি আমাদের বিভাগে যেন অতিসত্বর শিক্ষকদের পদ দেওয়া হয়। নতুন নিয়োগের মাধ্যমে বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে অনুপাত সেটাও রক্ষা পাবে।’

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কাজী এম. আনিছুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ইউজিসির কাছে পদ চেয়েছে। ইউজিসি পদ দিলে আশা করি বিভাগ শিক্ষক সংকট কাটিয়ে উঠবে।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর ধরে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এর মধ্যে এই বছর আরও কয়েকজন শিক্ষক উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশে গিয়েছেন। যে সমস্ত শিক্ষক উচ্চশিক্ষার পরেও ফিরে আসছিলেন না, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফিরে আসতে বলি । যারা আসেনি তাদের অনেকের দেনাপাওনা নিষ্পত্তি করে তাদের ধরে রাখা পদগুলো শূন্য করা হয়েছে। আর বাকিদের দেনা পাওনা নিষ্পত্তিসহ পদ শূন্য করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এ বছর বিদেশে যাওয়া শিক্ষকদের শূন্যতা পূরণের জন্য আমি পদ চেয়ে ইউজিসিতে বিশেষভাবে অনুরোধ করি। সে অনুযায়ি চলতি মাসে ইউজিসি আমাদের সেই সাতটি পদ দিয়েছে। আরও কিছু পদ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আশা করি দীর্ঘদিন ধরে থাকা আমাদের পদের যে সঙ্কট তা অনেকখানি লাঘব হবে।’

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ ব্যাপারে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তবে তিনি বলেন, ‘পদ দেওয়া হচ্ছে না এমন না। কিছুদিন আগেও দেওয়া হয়েছে।’

আরো পড়ুন