বিভাগের নাম কুমিল্লা নিয়ে বিতর্কের প্রাসঙ্গিকতা

ইতিহাস সাক্ষী দেয়, সৃষ্টি জগতের শুরু থেকে ব্যক্তি, বস্তু বা কোনো স্থানের শ্রুতিমধুর ও গুণবাচক নামের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রগৈতিহাসিককাল থেকে অর্থবোধক ও গুণবাচক নামের গুরুত্বের কারণে, অসংখ্য ফুল, নদী, পাখি ও বিভিন্ন বস্তুর মাধুর্য মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে আসছে। চোখে না দেখেও, মোহনীয় নামের আকর্ষণে প্রেয়সীর প্রতি ভালোবাসার ব্যাকুল অনুভূতি তৈরির উদাহরণ ও পৃথিবীতে আছে।

সৃষ্টি কর্তা স্বয়ং অসাধারণ ৯৯টি গুণবাচক ও অর্থবোধক নাম ধারণ করে আছেন। ঐশ্বরিক গুণবাচক এ নামগুলোর মাহাত্ম্য ও কার্যকরিতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। মহান আল্লাহর গুণবাচক এ সব নামের তাছবিহ্ পাঠে, বান্দার মানুসিক প্রশান্তি দোয়া কবুল ও ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে মানুষের দৃঢ়বিশ্বাস রয়েছে। মুসলিম ধর্মমতে তো বটেই পৃথিবীতে প্রচলিত হাজারো ধর্মানুসারীরাও গুণগত নামের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অনুধাবন করে থাকে।

সৃষ্টিকর্তাকে কেউ আল্লাহ, গড, ঈশ্বর, ভগবান, বিষ্ণু, প্রভু, ভাষা বেদে এমন অসংখ্য গুণগত নামে স্বীকার করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে যেগুলো মূলত: সবই স্রষ্টার গুণ, মান ও শান প্রকাশ করে থাকে। কাজেই সৃষ্টিগতভাবেই অর্থবোধক নামের প্রাসঙ্গিকতা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিশ্বমানবতার দূত রাসুল (সা.) ও উম্মতের প্রতি সুন্দর অর্থবোধক নাম নির্বাচনে বিশেষ গুরুত্বারোপের কথা বলেছেন। কাজেই নামের শ্রুতিমাধুর্য ও গুণগত মানের গুরুত্ব প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই চলমান। একটি শিশু ভূমিষ্টের আগে থেকেই শিশুটির মা-বাবা, আত্মীয় পরিজন সুন্দর নাম নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গুরুত্বপূর্ণ স্থান, স্থাপনা ও বস্তুর নাম নির্বাচনেও সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক জল্পনা কল্পনা ও গুরুত্বের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়।

পৃথিবীতে অনেক সম্প্রদায় রয়েছে যারা নাম নির্বাচনে ধর্মীয় আচার্যের উপস্থিতিসহ বিশাল আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত সম্পন্ন করে থাকে। এতে জন্মগতভাবে সুন্দর ও অর্থবোধক নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত। কাজেই নাম নির্বাচন কোনোক্রমেই হেলাফেলার বিষয় নয়।

সাম্প্রতিককালে সরকারি সিদ্ধান্তে কয়েকশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রুতিকটু ও নেতিবাচক অর্থ প্রকাশ পায়, এমন নাম পরিবর্তন করে শ্রুতিমধুর নাম নির্বাচনের বিষয়টি দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। প্রক্রিয়াটি চলমান রেখে, শ্রুতিকটু ও নেতিবাচক অর্থে প্রকাশিত নামগুলো পরিবর্তন করে, মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধা অথবা শ্রুতিমধুর নাম নির্বাচনের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এতে বরং মানুষের নান্দনিক ও আধুনিক রুচিশীলতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর বঙ্গে, চোরের ভিটা ও নটিপাড়া নামে দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

ভাববার বিষয় হলো, এমন অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামের নেতিবাচক অর্থ এতকাল ধরে আমাদের শিশুদের মননশীলতায় কি নিদারুণ নেতিবাচক প্রভাবই না ফেলেছে ! যুগ যুগ ধরে হয়তোবা এমনই গুরুত্বপূর্ণ বস্তু, স্থান-স্থাপনা, জেলা, উপজেলা ও গ্রামের নাম নেতিবাচক অর্থে প্রকাশ হয়ে আসছে, যা নিয়ে কেউ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। অথচ অর্থ ও এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় নামটি অগ্রহণযোগ্য। মানুষ এখন অনেক স্বচেতন, তারা সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার গুরুত্ব অনুধাবন করে।

এক্ষেত্রে কুমিল্লা নামটি বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন- কু+মিল্লা= কুমিল্লা- বাংলা অভিধান বা শব্দকোষে ‘কু’ শব্দটি- অব্যয় পদমর্যায় আসীন, এটি বিশেষ্য পদ, যার অর্থ- পাপ, দোষ, অমঙ্গল ইত্যাদি। বিশেষণ পদে এর অর্থ- দুষ্ট, মন্দ, কুৎসিত, কুটিল, জটিল ইত্যাদি। আর মিল্লা শব্দটি বাংলা ব্যাকরণ বিধি অনুযায়ী ক্রিয়াপদ। এর শব্দকোষ বা আভিধানিক অর্থ- একত্রিত হওয়া, যুক্ত হওয়া, মিলিত হওয়া, জোটবদ্ধ হওয়া, আরো সহজ করে বললে, সাদৃশ্য পূর্ণ, মিল্যা মিশ্যা বা মিল্লা-মিশ্যা।

তাহলে বর্ণ বিন্যাসে কু+মিল্লা= কুমিল্লা শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়, মন্দ কোনো কিছুর সমষ্টিগত বা জোটবদ্ধ হওয়া। এবার চলুন অভ্যুত্থান শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ জেনে নেয়া যাক। সামরিক অভ্যুত্থান মানে, সেনাবাহিনী কতৃক আকস্মিক ‘ক্যু’, বিদ্রোহ, Overthrwo বা উৎখাত।

ইংরেজি ভাষার মূল অভিধান Oxford English dictionary -তে যার পূর্ণ রুপ Coup. এই Coup শব্দটির বাংলা ভাষায় পরিবর্তিত সামরিক ভার্সনই হলো- ‘ক্যু’ যা আকস্মিক অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ বা সর্বনাস। তাহলে কু+মিল্লা= কুমিল্লা শব্দটির crystal-clear বা জলের মতো স্বচ্ছ বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, সম্মিলিত বা সামষ্টিকভাবে মিলেমিশে জোটবদ্ধ হয়ে মন্দ বা খারাপ কাজ সংঘটিত করা।

? কু শব্দটির এমন আরো অনেক নেতিবাচক অর্থ রয়েছে। যেমন- তেরছা, বক্র, কুট, কুজড়া, কুচুটিয়া, খল, ভন্ড, কপটচারী, দ্বিচারীভাব, অসরল, পেচিয়ে, অশুভ, অশুদ্ধ, খারাপ, অনিষ্ট, ক্ষতি, অসৎ, বদ, ক্ষতিকর, অলভ্য, অনিষ্ট, অপ্রাপ্য, অসাধ্য, অনিধগম্য, কলুষ, অপরাধ, পাপিষ্ঠ, বিদ্বেষপূর্ণ, দুর্নীতিপরায়ণ, খারাপ, পাপাত্মা, পাপপূর্ণ, অধম, গোনাহ, ত্রুটিপূর্ণ, ইত্যাদি। বহুল প্রচলিত প্রাচীন ও গ্রামীণ একটি প্রবাদ ও আছে যে-‘নামেনামে যমে টানে’।

অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দল ও মতের মানুষের সুদীর্ঘ সম্পর্কযুক্ত আবেগ ও বিরোধিতার বিষয়টি মাথায় রেখে; জনস্বার্থ বিবেচনায় রাষ্ট্র তার সঠিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় দীর্ঘমেয়াদের ফলাফল বিবেচনায় এ সিদ্ধান্তকে জনস্বার্থে, কল্যাণ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত বিবেচনা বলা যেতে পারে। আশির দশকে ছটাক, পোয়া, আধা শের, এক শের ও মণ পরিবর্তন করে যখন আধুনিক মেট্রিক পদ্ধতির গ্রাম, কেজি ও টনের প্রবর্তন করা হলো, সাধারণ মানুষ বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু আজ সেই সের ছটাকের কথা মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে। কারণ কিছুদিনের ব্যবধানেই তারা বুঝতে শুরু করে যে, বিশ্বায়নের এ যুগে সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। জনস্বার্থ বিবেচনায় এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নেয়া রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব।

এরই মধ্যে প্রস্তাবিত নতুন বিভাগের নাম কুমিল্লা নামটি নির্বাচন প্রসঙ্গে পক্ষে-বিপক্ষে কিছু আলোচনা, সমালোচনা, দাবি ও আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। বিষয়টি জাতীয় সংসদ পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু, যৌক্তিক কারণেই প্রধানমন্ত্রী তার সিদ্ধান্তে অটল। তিনি আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে; জাতির জনক হত্যাকারী জাতীয় বেঈমান খন্দকার মোশতাকের নাম সংশ্লিষ্ট কুমিল্লা নামে, কোনোভাবেই বিভাগ বাস্তবায়ন করবেন না। বিকল্প নামও তিনি বেছে নেয়ার অপশন দিয়েছেন, যেখানে মেঘনা নামটি তার নিজেরও পছন্দ।

বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে উন্নত দেশগুলোর মতো জঙ্গি বিমান, মিসাইল, বোমা, কিংবা আধুনিক সমর সরঞ্জাম হয়তো ছিল না। কিন্তু বুকে প্রচণ্ড সাহস, দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস, কোমড়ে গামাছা বাঁধা মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে ‘জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটির পরের স্লোগানটিই ছিল ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ তোমার আমার ঠিকানা।

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধাদের এ স্লোগান যদি দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা যেতো, পৃথিবীর এমন কোনো বাটখারা নেই, যা দিয়ে নতুন মানচিত্র অর্জনে স্বাধীনতার এ স্লোগানের ভার মাপা যেত!

নদীমাতৃক আবহমান বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এ স্লোগানটির সম্পর্ক শুধু আবেগের নয়, জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। কাজেই মেঘনা নামটি বিভাগের নাম হিসেবে নিঃসন্দেহে কুমিল্লাবাসীর জন্য অহংকারের।

শুধু খন্দকার মোশতাক নয়, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত অপর দুই খুনি ফারুক রশিদ ও কুমিল্লারই কুসন্তান। মন্দ কোনো উদাহরণ যত দ্রুত সম্ভব পেছনে ফেলে আসাই কল্যাণকর। কাউকে হেয় করার নিমিত্তে নয়, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিমজ্জিত আরেক জাতীয় বেঈমান মীর জাফরের জন্ম কুমিল্লায়! এ তথ্যটি যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে, গুগলে সার্চ দিতেই স্ক্রিনে মীর জাফরের জন্মস্থান কুমিল্লা ভেসে ওঠে। অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলাম ইতিহাস জানার ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে যতটা ঘাটাঘাটি ও পড়াশোনা করেছি, এ তথ্য সঠিক নয়।

মীরজাফর ভাগ্যান্বাশনে পশ্চিম থেকে আগত এক কুলাঙ্গার। সঠিক তথ্য নিশ্চিত হতে গিয়ে জানলাম, অসংখ্য অনুসন্ধিৎসু মানুষ বারবার বিষয়টি গুগলে সার্চ করার কারণে, Google artificial intelligence বা গুগল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টিকে Auto receive করে নিয়েছে। এর মানে; আত্মস্বীকৃত জাতীয় বেঈমানদের অনেকেরই জন্মস্থান যেহেতু কুমিল্লায়, এ আনুমানিক ধারণা থেকে মীরজাফর কিংবা তার বংশধরদের জন্ম কুমিল্লায় কি না, তা খুঁজতে গিয়ে, লোকজন গুগলে কয়েক মিলিয়ন বার সার্চ করায়, এখন Google Auto artificial intelligence ও বলছে মীর জাফরের জন্ম কুমিল্লায়। কাজেই আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত কুমিল্লাবাসীকেই নিতে হবে যে, জাতীয় কলঙ্কের মাত্র কয়েকজনের এই ভার বা কলঙ্ক তারা অনন্তকাল বয়ে বেড়াবেন, না কি সুন্দর অর্থবোধক কোনো নাম বেছে নেবেন, যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে স্বাধীনতা, দেশাত্মবোধ ও নির্মল সৌন্দর্যের অনুভূতি।

এ এইচএ খান রতন, লেখক : কলামিস্ট

আরো পড়ুন