কুমিল্লার বাহার কর্মী টুটুল, সহিদ, পাবেল, রিন্টুরা কোথায়?

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সারা দেশের ন্যায় কুমিল্লার পরিস্থিতিও বদলে গেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সুবাদে গত দেড় দশকে পুরোটা সময়ই জেলা সদরে দাপটের সাথেই ছিলো আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে নগরজুড়ে সে সময়ের এমপি বাহারের ছিলো একক আধিপত্য।

প্রশাসনের পাশাপাশি নিজ্স্ব কিছু কর্মী বাহিনীর কারণে পুরো নগর ছিলো বাহারময়। এই সময়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছিলো তার অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে। আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে এক মিনিটের জন্যও দাঁড়াতে দেয়া হয়নি বিএনপি-জামায়াতসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের। এমনকি বিভিন্ন সময় দলীয় প্রতিপক্ষ প্রয়াত অধ্যক্ষ আফজাল খানের অনুসারীদেরও সেখান থেকে মারধর করে বিতাড়িত করা হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে বাহারের অন্যতম ভ্যানগার্ডের ভূমিকায় ছিলেন চার নেতা। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন, আদর্শ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম টুটুল, ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নিয়াজ পাবেল, মহানগর যুবলীগ সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জিএস আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ এবং কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ভিপি জহিরুল ইসলাম রিন্টু। বাহারও তাদেরকে বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড হিসেবেই গর্ব করতেন।

তবে গত ০৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর কোথাও দেখা মিলছে না এসব নেতার। এক সময় যারা বাহারের বাহারি রাজত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যতম শক্তি ছিলেন, সেখানে তার বাড়ি ও দলীয় কার্যালয় জনতার আগুনে পুড়লেও তারা কিছু করতে পারেননি। আসলে বাহারের এই দু:সময়ে তারা কোথায় আছেন এ নিয়েও সাধারণ মানুষের কৌতূহল দেখা দিয়েছে। কারণ এক সময় এই চার নেতারই ছিলো নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। দলীয় যেকোনো কর্মসূচিতে তাদের নিজস্ব বাহিনীর উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। মূলত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি দফতরগুলোতে প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য সব সময় কাজ করেছে তাদের লোকজন। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে অস্ত্র ও গুলি করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ছিলো তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। আর বিভিন্ন দখল বাণিজ্য ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করাই ছিলো মূল জীবিকা।

টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করলেও এতোটা আলোচিত ছিলেন না অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম টুটুল। নগরীর ধর্মপুর ও অশোকতলায় স্থানীয়ভাবে কিছুটা সক্রিয় ছিলেন। তবে ২০১৪ সালের ১৯ মে আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হওয়ার পর নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির লাইমলাইটে চলে আসেন। এরপর অধ্যক্ষ আবদুর রউফের মৃত্যুতে উপ-নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন। সর্বশেষ চলতি ২০২৪ সালের এপ্রিলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান হন তিনি। অভিযোগ রয়েছে দুইবার কেন্দ্র দখল করে জয়ী হন তিনি। আর তৃতীয়বার বাহারের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কাউকে মনোনয়ন দাখিল করতে দেননি তিনি। ধর্মপুরে বিরোধী দল দমন ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করার অভিযোগও রয়েছে তার নামে। তারও ছিলো নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।

রেইসকোর্স ও শাসনগাছাসহ বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে প্রতিপক্ষকে নিপীড়নের অভিযোগ ছিলো আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের বিনা ভোটে নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নিয়াজ পাবেলের বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গত ০৩ আগস্ট পুলিশ লাইন ও ৪ আগস্ট আলেখারচর বিশ্বরোড এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।

এদিকে কুমিল্লা টাওয়ার হসপিটালসহ নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালসহ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয়ার অভিযোগ ছিলো মহানগর যুবলীগের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরে অবৈধভাবে বাণিজ্য করতেন বলে আলোচনা আছে। তারও ছিলো ক্যাডার বাহিনী।

অপরদিকে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ভিপি জহিরুল ইসলাম রিন্টুও চলতেন বেশ দাপটের সাথে। এক সময় ছাত্র নেতা থাকার সুবাদে তারও একটি নিজস্ব বলয় ছিলো। শহরের যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে মিছিল করতেন তার অনুসারীরা। এ সময় প্রতিপক্ষকে ঠেঙ্গানোর বিষয়ে ছিলেন বেশ আলোচিত। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় বিএনপি-জামায়াতের একাধিক প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়ার বিষয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ এ বছরের ১ এপ্রিল নগরীর টমছম ব্রিজ সংলগ্ন শিক্ষা প্রকোশলীর কার্যালয়ে মাসুদুল ইসলাম বাবু নামে এক ঠিকাদারকে প্রকাশ্যে নিজ পিস্তল দিয়ে গুলি করার ঘটনায় মামলা হয়েছে তার নামে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর যুবলীগের এক নেতা বলেন- সে সময়ে এমপি বাহারের নাম ভাঙ্গিয়ে এ চার নেতা বিপুল অর্থের মালিক হলেও বর্তমানে দলের দুর্দিনে কেউ মাঠে নেই। অবশ্য এ চার নেতার সাথে কথা বলতে চাইলেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
এছাড়া অস্ত্রধারী সালেহ আহমেদ রাসেল, শাওনসহ অন্যরাও পালিয়ে গেছেন।

এ ব্যাপারে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পেশীশক্তি নির্ভর রাজনীতি কখনও কাম্য নয়। কারণ অনৈতিক সুবিধাভোগীরা কখনই দেশপ্রেমিক হতে পারে না। ব্যক্তি বিশেষের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের আখের গোছানই তাদের কাজ। তাই বর্তমানে নতুন প্রজন্মের চাওয়া অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি করে দেশ পরিচালনা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

সূত্রঃ আমোদ

আরো পড়ুন