উন্নত ও সমৃদ্ধ জেলা কুমিল্লা
এসএন ইউসুফঃ বাংলাদেশের একটি অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধ জেলা কুমিল্লা। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আন্দোলনের পাদপীঠ এই জেলা। কুমিল্লার খাদিশিল্প, তাঁতশিল্প, কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প ও কারুশিল্পের পাশাপাশি ময়নামতির শীতলপাটি প্রভৃতি নিজ ঐতিহ্য আজও বজায় রেখে চলেছে। কালের বিবর্তনের ধারায় এসেছে অনেক কিছু, অনেক কিছু হারিয়েও গেছে, হারায়নি এখানকার মানুষের আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথেয়তা ও সামাজিক সম্প্রীতি। কুমিল্লাকে নিয়ে অনেকেই লেখেন। আমি কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
বাংলা সাহিত্যের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ নামে বইয়ে প্রথম ‘বঙ্গ’ নামে উপজাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। বঙ্গ, সমতট, বরেন্দ্র, গৌড়, রাঢ় প্রভৃতি নামের সঙ্গে পরিচিত হই বইটির মাধ্যমে। কুমিল্লা ছিল প্রাচীন ‘সমতট’ জনপদের অংশ। ৭ম থেকে ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত তা পল্লবিত হয়েছে। ১২৩৪ সালে দামোদর দেবের অপ্রকাশিত মেহার পট্রোলি পড়ে জানা হয়, কুমিল্লাই ছিল সমতটের প্রধান কেন্দ্র। পরে নানা সময় নানাভাবে জেলার ভৌগোলিক সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানি লাভ করার পর ত্রিপুরাকে দুই অংশে ভাগ করে। এক অংশের নামকরণ করা হয় ‘চাকলা-রৌশনাবাদ’। অন্য অংশের নাম রাখা হয় ‘ত্রিপুরা’। তবে সামগ্রিকভাবে ‘ত্রিপুরা’ বলতে কখনও পার্বত্য ত্রিপুরা, কখনও বর্তমান কুমিল্লা, আবার কখনও ত্রিপুরা-পার্বত্য ত্রিপুরাকে বোঝানো হতো। এর সীমা ছিল বর্তমান বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ ও সিলেটের অর্ধাংশ। নোয়াখালীর এক-তৃতীয়াংশ ও ঢাকা জেলার কিয়দংশ। ত্রিপুরাধিপতিদের জমিদারি ছিল বেশ। অপরদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বা ত্রিপুরা জেলার ‘ত্রিপরা প্রপার’ বলতে চাকলা-রৌশনাবাদকে বোঝাত। অন্য গ্রন্থে জানা যায়, ইংরেজ সরকার এ জেলাকে তখন রৌশনাবাদ-ত্রিপুরা বলত। ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তা ত্রিপুরা হতে বিচ্ছিন্ন করে ঢাকার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে করে ত্রিপুরা অনেকটা ছোট হতে থাকে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জেলাটি ত্রিপুরা জেলা নামে পরিচিত ছিল। ওই বছরের আগস্টে এক প্রশাসনিক আদেশে একে কুমিল্লা জেলা নামে অভিহিত করা হয়। দেশের পুরাতন ১৯ জেলার অন্যতম এটি। ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর কুমিল্লার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা দুটি পৃথক জেলার মর্যাদা লাভ করে।
জেলার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দক্ষিণে ফেনী ও নোয়াখালী, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমে চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ। বর্তমানে একটি সিটি করপোরেশন, আটটি পৌরসভা ও ১৭টি উপজেলা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কুমিল্লাই বাংলাদেশের একমাত্র জেলা, যেখানে সর্বাধিক উপজেলা রয়েছে।
এবার আসি মূল আলোচনায়। আমাদের দেশের অন্য জেলার মতো ধর্মীয় পরিচয়ের আলোকে কুমিল্লায় আনুপাতিক হারে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। এ শহরে সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে। এ জেলায় যুগে যুগে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও বিখ্যাত ব্যক্তির জš§ হয়েছে, যাদের আলোকিত কর্মের সুফল ভোগ করছে গোটা দেশ।
এবার মুদ্রার অপর পিঠটি দেখে নেওয়া যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায়ই নাগরিক সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। কুমিল্লার অব্যবস্থাপনা নিয়ে আমি বেশ হতাশ। এমন হতাশা নিয়ে নাগরিকরা তাদের কর্মব্যস্ত জীবন শুরু করে; আবার হতাশা নিয়েই বাসায় ফেরে। সম্ভাবনা কিংবা উত্তরণের কোনো সুষ্ঠু সমাধান নেই যেন কারও কাছে। এক সময় শিক্ষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতির পাদপীঠ হিসেবে থাকা সেই খ্যাতিও মুছে যাওয়ার পথে।
জেলার কোথায় আবাসিক এলাকা, কোথায় বাণিজ্যিক এলাকা হবে, তারও নিয়মনীতি নেই। শহরটায় যানজট লেগেই থাকে। যানজট নিরসনে জেলা প্রশাসনের মাসিক উন্নয়ন সভা কিংবা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে তা যেন টেবিলেই সীমাবদ্ধ। একটি উন্নত জেলা হিসেবে এখানে নেই কোনো নিয়মের বালাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক সময় কুমিল্লা শহরের মূল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলা হতো নগরীর চকবাজারকে। এর প্রধান সড়কটিতে প্রবেশের জন্য যদি তেলিকোটা চৌমুহনী হয়ে প্রবেশ করে কাশারীপট্টি মোড় পর্যন্ত আসতে চান, তাহলে অন্তত আধঘণ্টা কিংবা এক ঘণ্টা অতিরিক্ত রাস্তায় পার করতে হয়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে নিউ হোস্টেল পর্যন্ত সড়কটিতে যানজটে আটকা পড়ে বসে থাকতে হয় আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা। অনেক লেখালেখির পর এখান থেকে বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে নগরীর জাঙ্গালিয়া এলাকায় নেওয়া হলেও বর্তমানে ‘যেই লাউ সেই কদু’ অবস্থা।
অপরিকল্পিতভাবে হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ হচ্ছে। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো শহরটিকে একটি ইট-কাঠের নগরীতে পরিণত করছে। শুধু নির্মাণই চলছে, নেই সুষ্ঠু পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেনেজ সিস্টেম, পরিকল্পিত ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, নিরাপদ খাবার পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ। পুকুর ভরাট আর গাছপালা কেটে ভবন নির্মাণের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, নদীভাঙন, খরা, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি প্রভৃতি কারণে বর্তমানে নগরীতে সামান্য বৃষ্টিতে প্রধান সড়কগুলো তলিয়ে যায়।
আমি ক্ষুদ্র মেধা দিয়ে এসব অব্যবস্থাপনা থেকে উত্তরণের পথ কীভাবে পাওয়া যাবে, তা প্রায়ই উল্লেখ করি বিভিন্ন লেখায়। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাকে আমরা পৃথক না করলে কোনোদিনই এ শহরকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে ভাবতে পারব না। ইতিপূর্বে নগরীর পরিধি দক্ষিণে বর্ধিত হয়েছে। এখনও সুযোগ রয়েছে, পশ্চিম দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পর্যন্ত বর্ধিত হওয়ার। কারণ এর পশ্চিমে সেনানিবাস, শালবন বিহার, ময়নামতি জাদুঘর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। নগরীর বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ সরিয়ে সদর দক্ষিণাংশ কিংবা নগরীর পদুয়ারবাজার বিশ্বরোড অংশে স্থানান্তর করা উচিত। নগরীতে যেমন রয়েছে অনেক নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঠিক তেমনি সদর দক্ষিণাংশে এমন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গেলেও শহরের ওপর থেকে চাপ কমতে পারে। শহরটির কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া গোমতী নদীর সঙ্গে শহরের ট্যানেলের ন্যায় বিশাল আকারের ড্রেনেজব্যবস্থা নগরের পানি নিষ্কাশরের একটি মহাউদ্যোগ হতে পারে।
বিশ্বায়নের এ যুগে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যদি তাদের করপোরেট রেসপনসিবিলিটি পালন করে প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান নিয়ে বাস্তবতা বিচার করে, তাহলে সুপরিকল্পিত নগরী পাব আমরা। তবেই আমরা আগামী অর্ধশতকের মধ্যে কুমিল্লাকে একটি সুখী-সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী পরিকল্পিত নগরী হিসেবে দেখতে পাব।
আসুন না, এক এক করে এ মহানগরের বর্তমান সমস্যাগুলো মাথায় নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্তা কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করি। ভবিষ্যৎ প্রজš§কে উপহার দিই একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও মনোরম পরিবেশের কুমিল্লা।