কুমিল্লা-৫ নতুন পুরোনোর দ্বন্দ্ব দুই দলেই
ডেস্ক রিপোর্টঃ বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-৫ নির্বাচনী এলাকা। চারবার করে এখান থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আবদুল মতিন খসরু ও বিএনপির মো. ইউনুস। খসরু চারবারই আওয়ামী লীগ থেকে আর ইউনুস বিএনপিসহ একাধিক দলের মনোনয়নে নির্বাচনে অংশ নেন। এবার তাঁরা নিজ দলেই বিরোধিতার সম্মুখীন। ভোটাররা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নতুন মুখ দেখতে চান বলে এলাকায় প্রচার করছেন অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
এই দুই নেতার যেমন জনপ্রিয়তা আছে, তেমনি তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সাধারণ ভোটাররা অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছেন। এলাকার বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা রাস্তাঘাটের নাজুক অবস্থা, মাদক প্রবেশ, গ্যাস-সংযোগ না পাওয়া এবং উপজেলা সদরের কলেজ জাতীয়করণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেক ভোটারও বলেছেন, তাঁরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নতুন মুখ দেখতে চান।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের উত্তর তেঁতাভূমি গ্রামের ভোটার আলাউদ্দিন কাজল বলেন, ‘এলাকাতেই রয়েছে সালদা গ্যাসক্ষেত্র। ব্রাহ্মণপাড়া-বুড়িচংয়ের ওপর দিয়ে গ্যাসের পাইপলাইন গেলেও আমরা এর সুফল পাচ্ছি না।’ বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের আজ্ঞাপুর গ্রামের মনির হোসেন বলেন, সীমান্তে মাদক ঠেকাতে না পারার কারণে তরুণ প্রজন্ম বিপথে যাচ্ছে। এ নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
কোন্দলে আওয়ামী লীগ
১৯৮৬ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মতিন খসরু। এবারও তিনি মনোনয়ন চাইছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন।
এবার কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বুড়িচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ ছাড়া ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সোহরাব হোসেন চৌধুরীও গণসংযোগে নেমেছেন। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য আবদুছ ছালাম বেগ।
বুড়িচং উপজেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ থেকে আবুল হাশেম খান (সভাপতি) এবং সাজ্জাদ হোসেনের (সাধারণ সম্পাদক) কমিটি চলছিল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রেখে কমিটি পুনর্গঠন করে জেলা কমিটি। কিন্তু এরপরই আখলাক হায়দারকে সভাপতি ও রেজাউল করিমকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা দেন মতিন খসরু। এতে দলের একাংশের নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হন।
দায়িত্বশীল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র জানায়, বুড়িচং এবং ব্রাহ্মণপাড়া দু’টি উপজেলায় আ’লীগের দ্বন্ধ চরমে। বুড়িচংয়ে একপক্ষে রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমান কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আ’লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বপন এবং অপরপক্ষে রয়েছেন গত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ময়নামতি ইউনিয়নের সাবেক দু’বারের চেয়ারম্যান আখলাদ হায়দার , তার ভাই জেলা পরিষদ সদস্য তারিখ হায়দার ও বর্তমান ময়নামতি ইউপি চেয়ারম্যান লালন হায়দার । তাদের বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্যেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র জানায়, বিগত উপজেলা নির্বাচনে আখলাদ হায়দার দলের বাইরে থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করলে সাজ্জাদ হোসেনের পরাজয় নিশ্চিত হয়। একইভাবে জেলা পরিষদ নির্বাচনেও আখলাদ হায়দার, তারেক হায়দার ও লালন হায়দার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সাজ্জাদ হোসেনর বিরুদ্ধে গোপনে বিরোধিতা করায় সাজ্জাদ হোসেন স্বপন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বুড়িচং উপজেলা সাবেক চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন স্বপন দক্ষিণ জেলা আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিব এবং স্থানীয় আ’লীগ দলীয় এমপি’র অনুসারী হওয়ায় আ’লীগ নির্দেশ অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কুমিল্লা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ও দলীয় ভাবে কোনঠাসা হয়ে আছে। তবে তিনি বুড়িচং উপজেলায় আ’লীগের ও অংগ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখছেন।
তাছাড়া গ্রুপিংয়ের কারনে বুড়িচং উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সারোয়ার আলম পলাশ হত্যা মামলার অভিযোগ তো আছেই এই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের উপর এবং বুড়িচং উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট রেজাউল করিম খোকনকে ২০০১ সালে হত্যা চেস্টার অভিযোগ সহ দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব তো আছেই তার বিরুদ্ধে। সাজ্জাদ হোসেন স্বপন বুড়িচং উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে লাগামহীন দুর্নীতির কারনে গঠিত তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।
একই অবস্থা ব্রাহ্মণপাড়ার ক্ষেত্রেও। বিগত উপজেলা নির্বাচনে এ উপজেলা থেকে এমপি মতিন খসরুর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন জাহাঙ্গীর খান চৌধুরী। কিন্তু সেখানেও স্বতন্ত্র প্রার্থী পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন আরেক আ’লীগ নেতা আলহাজ্ব আবু তাহের। ফলে এখানেও উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান চৌধুরী ও গত উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত আ’লীগ নেতা আলহাজ্ব আবু তাহের দুইভাগে বিভক্ত। বর্তমানে এখানে রাষ্ট্রীয় কোন সভা সমাবেশে আবু তাহের অংশগ্রহণ না করলেও তার ব্যক্তিগত অর্থায়নে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে তিনি প্রতিনিয়ত।
স্থানীয় লোকজন জানান, তাদের এই দ্বন্দ্বের সুত্রপাত বিগত উপজেলা নির্বাচনে দল থেকে আলহাজ্ব আবু তাহের মনোনয়নের জন্য জোর দাবী জানিয়েছিল ওই আসনের এমপি আব্দুল মতিন খসরুর কাছে। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীতায় দলীয় সিদ্ধান্ত জাহাঙ্গীর খান চৌধুরীকে দেয় এবং কথিত আছে গোপনে শপথ করে আলহাজ্ব আবু তাহেরকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করিয়ে দেন তিনি। নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে তখন এমপি আব্দুল মতিন খসরুর অবস্থান জানতে বাধ্য করা হলে এবং প্রশ্নবিদ্ধ পদ্ধতিতে দলীয় প্রার্থী জাহাঙ্গীর খানকে জিতিয়ে আনেন। সে থেকে দু’ব্যক্তির দ্বন্দ্বে দলের মধ্যে যেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি করে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও দুভাগে বিভক্ত।
মনোনয়নপ্রত্যাশী সোহরাব হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে আওয়ামী লীগে নতুন প্রজন্মের প্রার্থী লাগবে। অ্যানালগ লোক দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে না। তাই দলের কাছে মনোনয়ন চাইব।’
আবদুছ ছালাম বেগ বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়নকাজ কেউ তুলে ধরছে না। তাই আমি দলের জন্য বিলবোর্ড লাগিয়েছি। আশা করি দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
বর্তমান সাংসদ আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘দলে কোনো কোন্দল নেই। বুড়িচং উপজেলা কমিটি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। সেগুলো মিটমাট হয়ে যাবে। আর দলের যেকোনো নেতা-কর্মী মনোনয়ন চাইতেই পারেন। এটা দোষের নয়। সবাই আমরা নৌকা প্রতীকের পক্ষেই থাকব।’ ভোটারদের ক্ষোভের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের জন্য দীর্ঘদিন থেকেই চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার আগে শিল্পকারখানায় গ্যাস দিতে চায়, এরপর গৃহস্থালি।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষ নতুন নেতৃত্ব চায়। এ জন্য তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন।
বিএনপিতেও দ্বন্দ্ব
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শওকত মাহমুদ ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা বিএনপির সমন্বয়কারী। এবার তিনি এ আসনে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হতে গণসংযোগ শুরু করেছেন। তাঁকে ঠেকাতে মরিয়া সাবেক সাংসদ মো. ইউনুস। দুজনই জড়িয়ে পড়েছেন দ্বন্দ্বে। ২০০৮ সালে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী এ এস এম আলাউদ্দিন ভূঞা হেরে যান মতিন খসরুর কাছে।
ইউনুস ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ, ’৮৬ সালে স্বতন্ত্র, ’৮৮ সালে জাতীয় পার্টি এবং ২০০১ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে সাংসদ হন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যাঁরা আমার সঙ্গে গণসংযোগে বের হন, তাঁদের বহিষ্কারের হুমকি দেন শওকত মাহমুদ। আমি সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলেও বাধা দেন। এরপরও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ, আসনটি পুনরুদ্ধার করতে হলে আমাকেই মনোনয়ন দিতে হবে। এলাকায় শওকত মাহমুদের কোনো অস্তিত্ব নেই।’
ইউনুসের অভিযোগের জবাবে শওকত মাহমুদ বলেন, ‘উনি (ইউনুস) তো বিএনপিতে নেই। এরপরও দলীয় সদস্য ফরম এলাকায় বিলি করছেন। ওনার সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। মতিন খসরু ও মো. ইউনুস দুজন মিলে আটবার এলাকার সাংসদ ছিলেন। তাঁরা টেকসই কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি। গ্যাস আনতে পারেননি।’ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মতিন খসরুকে ঠেকাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার দরকার বলে মন্তব্য করেন এই সাংবাদিক নেতা। দলে কোনো কোন্দল নেই বলে তিনি দাবি করেন।
এ এস এম আলাউদ্দিন ভূঞা বলেন, ‘দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। ২০০৮ সালে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। এবারও দেবে।’
স্থানীয় সুত্র জানায়, এই উপজেলায় রয়েছে বিএনপি’র একটি বিশাল ভোট ব্যাংক। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি’র কোন নেতাই এই উপজেলার বিএনপি’র সমর্থকদের সংগঠিত করতে এগিয়ে আসেননি। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে এই ব্রাহ্মণপাড়া থেকে বিএনপি’র কোন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করে নাই। তবে মাঝে মাঝে পত্রিকার সংবাদে আসা জসিম উদ্দিন নিজেকে এই এলাকার নেতা হিসেবে প্রচার করলেও রাজনীতির মাঠে তিনি নিরব। পরবর্তীতে শওকত মাহমুদ দলের পক্ষে এখানে হাল ধরলে উজ্জীবিত হয়ে উঠে নেতা-কর্মীরা।
এদিকে আসনটির বুড়িচং উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি পদে মিজানুর রহমান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে থেকে দল পরিচালনা ও উপজেলা প্রশাসন কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন । জনশ্রুতি আছে আ’লীগের একটি সুবিধাভোগী অংশের সাথে গোপন আতাত করে টিকে আছেন।
বুড়িচং উপজেলায় বিভক্ত আ’লীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দুস্কৃতিকারীদের দলের প্রভাবমুক্ত সাধারন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে নৌকার প্রার্থীর জন্য আগামীর সংসদ নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আ’লীগ ও বিএনপি উভয় দলের কর্মীদের চাওয়া নতুন মুখের প্রার্থী দিলে আভ্যন্তরিণ কোন্দল প্রশমিত হয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আ,লীগ ও বিএনপির সত্যিকারের জনপ্রিয়তা প্রকাশ পাবে।
আসনটির বুড়িচং উপজেলায় ভোটার সংখ্যা দু’লাখ ৬৬ হাজার ৯৩ জন। ব্রাহ্মণপাড়ায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ১’শ০৬ জন ভোটার রয়েছেন। দু’উপজেলার সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ৩০ হাজার। পাশাপাশি জামায়াতের রয়েছে বিশাল ভোট ব্যাংক। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত এরাই হয়তো নির্ধারন করবে কে হবে আগামীতে এই আসনের সংসদ সদস্য।
সূত্রঃ প্রথম আলো