কুমিল্লা শালবন বিহারে দর্শনার্থী কমছে আশঙ্কাজনক হারে
মো.জাকির হোসেনঃ কুমিল্লা লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ে আবিস্কৃত প্রতœতত্ত্ব সম্পদের মাঝে সবচেয়ে বড় নিদর্শন শালবন বিহার। কেউবা বলে শালবন বৌদ্ব বিহার আবার কেউ বলে শালবন মুড়া। কোটবাড়ি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিনে শালমানপুর এলাকায় বিহারটি অবস্থিত। এর পাশে রয়েছে প্রাকৃতিক শালবন। জনশ্রুতি আছে শালমানপুর থেকে এটি শালবন বিহার হিসেবে পরিচিতি পায়। পাক-ভারত বিভক্তির পর বিগত শতাব্দির ৫০ এর দশকের মাঝামাঝি শালবন বিহারে প্রতœাৎখনন কাজ শুরু হয়। এরপর কিছুটা সময় বন্ধ থাকলেও ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বিহারের বিশাল এলাকাজুড়ে চলে এই খনন কাজ। এসময় ৬ টি বসতি আমলের চিহ্নসহ একটি ১৬৭.৬ মি. বর্গাকার বিহারের ধ্বংসাবশেষ বেরিয়ে আসে। বিহারের চারটি বাহুতে সারিবদ্ধ ভিক্ষুকোঠা এবং এর সামনে একটা টানা বারান্দা রয়েছে। বাহুগুলো একটি বর্গাকার চত্বর ঘিরে রেখেছে। আর বিহারের ভিতর প্রবেশের জন্য উত্তর বাহুর মাঝখানে একটি তোরন আছে। খোলা চত্ত্বরটির কেন্দ্রজুড়ে আছে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। বিহারের বাহুগুলোর পিছনের দেয়াল ৫ মিটার চওড়া।
শালবন বিহার ১৯৫৫ সালে খনন কাজ শুরুর পর আবিস্কৃত বিহারের বাহুগুলোর দেয়ালগুলোতে ঠেস দেওয়া বিহারের ভিতর দিকে মুখ করা ৩.৬ মি. বর্গাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত মোট ১১৫ টি ভিক্ষু কোঠা অস্তিত্ব বেরিয়ে আসে। প্রতিটি কোঠা সামনের দিকের ২.৫ মি.চওড়া টানা বারান্দার সাথে তীর্যকভাবে বিন্যস্ত এবং ৯১.৪ সেমি.চওড়া একটি করে দরজা দিয়ে প্রতিটির সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল । এসব ভিক্ষুকোঠার দরজায় চৌকাঠ ও কাঠের পাল্লা এবং লোহার হুড়কা ও কবজা ব্যবহৃত হয়েছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়। অধিকাংশ ভিক্ষুকোঠার ভিতর দিকের পিছনের দেয়ালে তিনটি করে কুলঙ্গির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এছাড়াও প্রতিটি ভিক্ষুকোঠার মাঝখানে ১.৫মি.চওড়া বিভাজক দেয়াল রয়েছে। বিহারের উত্তর বাহুর মাঝখানে অবস্থিত চওড়া তোরনটি একটি ১০.৬ বাই ৭.১মি.পরিমাপের হলঘর আকারে তৈরী। এছাড়া এর দু’পাশে দুটি করে প্রহরী কোঠা রয়েছে। তোরনে উঠানামার জন্য বিহারের ভিতর ও বাইরে আলাদা সিড়ির ব্যবস্থা ছিল। বিহারের প্রথম বসতি আমলটি খড্ক ও রাত শাসনামলের সাথে সম্পর্কযুক্ত। দ্বিতীয় বসতি আমলে এর মেঝে কিছুটা উচুঁ করা হয়েছিল। তৃতীয় বসতি আমলটি সমৃদ্ধির পর্যায় বলে ধারনা করা হয়। এসময় পিছনের দেয়ালের প্রস্থ ১.৯ মি. কমিয়ে ভিক্ষুকোঠাগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়। চতুর্থ বসতি আমলে পূর্ববর্তী আমলের দরজা , মেঝে ও কুলঙ্গিগুলো ভেঙ্গে ঢেকে দিয়ে নতুন মেঝ ও দরজা তৈরী করা হয়েছিল। এছাড়াও পূজাঁ অর্চনার জন্য একটি পাকা বেদী নির্মান হয়। সেসাথে প্রতিটি কোনে অবস্থিত কোঠার ছাদে উঠার উপযোগী সিড়ি নির্মান হয়েছিল। প ম বসতি আমলের শেষ দিকে খ্রীষ্ট দশ/একাদশ শতকে পুরা পুরাস্থাপনাটি ধ্বসে পড়তে শুরু করে। এসব ধ্বংস্তুপের মাঝে তাই জমাটবদ্ধ মশলার বড় বড় পিন্ডসহ কাঠের রুয়া ও আড়ার পোড়া কয়লা ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ষষ্ঠ বসতি আমলের (খ্রীষ্ট বার শতক) চিহ্নগুলো একেবারেই ঢাকা পড়ে যায়। প্রথম নির্মান আমলের অক্ষত অংশগুলো থেকে ধারনা করা হয় মন্দিরটি ক্রুশাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছিল। এই মন্দির পরিকল্পনাকে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় অবস্থিত কলসন মন্দির (খ্রি.৭৭৮ সাল) মিয়ানমারের প্যাগানের আনন্দ মন্দিও (খ্রি.১০৯০ সাল) এবং বাংলাদেশের সোমপুর,পাহাড়পুর বৌদ্ব বিহারের প্রথম নির্মান আমলের (খ্রি.৭৮১-৮২১ সাল) স্থাপত্যকলার উৎসসুত্র হিসেবে গন্য করা হয়। দ্বিতীয় বসতি আমলে মন্দিরের আকার কমে যায়। তৃতীয় বসতি আমলে আগের কিছু নির্মান কাজ অবিকৃত থাকলেও পরিসর আরো কমে যায়। পরবর্তী বসতি আমলগুলোর নিদর্শনাদি একেবারেই জরাজীর্ণ। ফলে এআমলের স্থাপত্যিক বিন্যাস সম্পর্কে পুরোপুরি ধারনা প্রদানের সুযোগ নেই। বিহার তোরনের সাথে বিহারের বাইরে ৫৩মি. লম্বা ও ৯১.৪সেমি চওড়া ইটের সংযোগ রাস্তা ছিল। এসকল দিক বিবেচনা প্রতœতত্ববিদরা পুরোস্থাপনাটি একটি মন্দিরের কাঠামো বলে ধারনা করা হয়।
প্রতেœাৎখননের ফলে বিহার চত্বরে যেসব মুদ্রক-মুদ্রিকা উম্মোচিত হয়েছে তাতে অনুমান করা হয় ময়নামতি থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে জেলার দেবিদ্বার উপজেলা সদরের গুনাইঘরে পাওয়া খ্রি.ছয় শতকে জারি করা বন্যগুপ্তের ধাতুর লিপিফলকটির সাথে অনেকটা সাদৃশ্য। এথেকে ধারনা করা হয় শালবন বিহারের প্রথম বসতি খ্রি.ছয় শতক। শালবন বিহার এলাকায় সর্বশেষ ২০১৬-’১৭ অর্থ বছরে সর্বশেষ খনন ও কিছু সংস্কার কাজ হয়। এখানে প্রতœাৎখননে আবিস্কৃত পুরাকীর্তির মাঝে রয়েছে ৮ টি তা¤্রলিপি , ৪’শতাধিক স্বর্ন ও রৌপ্য মুদ্রা , অনেক পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিল মোহর , ব্রোঞ্জ ও মাটির মুর্তি। বিহারের পাশেই রয়েছে ময়নামতি যাদুঘর। এখানে উদ্ধার হওয়া নিদর্শনগুলো দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে। শালবন বিহারের কাছাকাছি দুরত্বে রয়েছে ইটাখোলা,রূপবান,লতিকোট,চারপত্র,কোটিলা,আনন্দ মুড়া,ভোজরাজার বাড়ি। এরমাঝে কোটিলা,চারপত্রমুড়া,আনন্দ রাজার মুড়া ময়নামতি সেনানিবাস এর ভিতরে অবস্থানের কারণে দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়াও লালমাই-ময়নামতিতে আবিস্কৃত অন্যতম নিদর্শন ময়নামতি রানী প্রাসাদ কোটবাড়ি শালবন বিহার থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এরবাইওে শালবন সংলগ্ন এলাকায় আরো আছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, নব বৌদ্ব মন্দিরসহ রয়েছে বেশ কটি বেসরকারী বিনোদন পার্ক। প্রতিদিন দেশ বিদেশের অনেকেই আসেন শালবন বিহার ও যাদুঘর পরিদর্শনে। চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ থেকে আসা মাসুদ নামের এক ব্যবসায়ী জানান, ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে আসা দর্শনার্র্থীদের শালবন বৌদ্ববিহার ও যাদুঘর এলাকায় পানি ও টয়লেট সুবিধা না থাকায় দুর্ভোগের স্বীকার হতে হয়। আর এসবের কারণে প্রতিদিন দর্শনার্থী সংখ্যা কমছে বলেও দায়িত্বশীল সুত্র নিশ্চিত করছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম,সিলেট প্রতœতত্ব অধিদপ্তরের আ লিক পরিচালক ড.আতাউর রহমান বলেন, ২০১৭-’১৮ অর্থ বছরের তুলনায় ২০১৮-’১৯ অর্থ বছরে পর্যটন সংখ্যা কমেছে। এসময় প্রায় দেড় কোটি টাকা রাজস্বের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারন করা হলেও আয় হয় এক কোটি ৫ লাখ টাকা। তিনি আরো বলেন, শালবন বিহার,যাদুঘর ও গাড়ি পার্কিংয়ের নির্ধারিত স্থানে ৬ টি টয়লেট আছে। তবে সেগুলো বিপুল দর্শনার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত না। এছাড়াও শেড না থাকায় রোদে বা বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় দর্শনার্থীদের। এদিকে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ না থাকায় এ সব নির্মানের কোন সম্ভাবনাও নাই। এছাড়াও তিনি আরো বলেন, রাতে শালবন বিহারের চারপাশে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করায় আগের চেয়ে এটা অনেক নিরাপদ।