কোটায় পিছিয়ে পড়ছে কুমিল্লা, পেশায় হারাচ্ছে কৃতিদের কৃতিত্ব

কোটা ব্যবস্থা। সংবিধান ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি হলেও আজও বহাল এই ব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার এতোবছর পরও সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। শুধু কি স্বীকৃত কোটা, অস্বীকৃত- অদৃশ্য কোটাও যোগ হয়েছে তার সাথে। আসলে কোটার বাইরে সাধারন মেধাবীদের জন্য চাকরিতে অবশিষ্ট কোটা আছে কি না এটাই এখন প্রশ্ন ? শ্রেণি ও জেলা কোটা ব্যবস্থার সাথে সাথে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কোটাও চালু রয়েছে সর্বত্র। স্বীকৃত-অস্বীকৃত মিলে সাধারনের চাকরির সুযোগ বলা যায় শূন্যের কোঠায়।

এরকম অবস্থায় বছরের পর বছর ধরে মৌলিক দাবি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারন পরিবারের শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-যুবরা। এদিক থেকে কুমিল্লার মতো একটি অগ্রসর জেলার অবস্থা আরো খারাপ। এই জেলার শিক্ষা সমাপ্ত করা সন্তানরা কোটা ব্যবস্থার শিকারে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলা যায় একটানা চারদশক ধরে। মেধা-যোগ্যতায় অবস্থান থাকলেও কোটার কারণে উপেক্ষিত হচ্ছেন চাকরি এবং উচ্চ শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে। সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও কোটা ব্যবস্থার অনুসরনে কুমিল্লার মেধাবিরা অন্য জেলার চেয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত। কুমিল্লা জেলা শিক্ষা ও শিক্ষিতের হারের হিসাবে বর্তমানে প্রথম অবস্থানে না থাকলেও নিচের দিকেও খুব বেশি ব্যবধানে নেই। শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত মিলিয়ে শিক্ষায় একটি নিয়মিত ও ধারাবাহিক সাফল্য এপর্যন্ত এখানে বজায় আছে। ফলে প্রতিবছর যে সংখ্যক শিক্ষার্থী সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষা জীবন শেষ করছেন সে তুলনায় মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে তাঁদের স্থান নেই বললেই চলে।

কোটা ব্যবস্থার অন্যার্য বাস্তবতার মুখে পড়ে কুমিল্লার শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছেন বছরের পর বছর, এভাবে অনেক বছর সরকারি যে কোনো উপযুক্ত চাকরি থেকে। সরকার প্রবর্তিত শ্রেণি কোটা ছাড়াও জেলা কোটা হিসেবেও শুভংকরের ফাঁকিতে রয়েছে কুমিল্লা জেলা। এধরনের একটি অসম, অন্যার্র্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের মাঝে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। জাতীয় পর্যায়েও নানা মাধ্যমে কোটা ব্যবস্থার অপ্রয়োজনীয়তা এবং ক্রমান্বয়ে তা তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে দেশের অনেক বিশিষ্টজন তাঁদের মতামত দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সামান্যতম কোনো কাজ হয়নি, কোনো সরকারই বিষয়টি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করেনি। অনেকের মতে কোটা ব্যবস্থার মতো একটি চরম বৈষম্য মূলক ব্যবস্থার বর্তমান প্রেক্ষিতে আর কোনো যুক্তিকতা না থাকলেও কেবল রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

কোটা ব্যবস্থা ছাড়াও সরকারি চাকরি লাভ বা পদায়নে রাজনৈতিক প্রভাব, পরিচয় অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় ছাড়াও মিলছে না অনেক যোগ্য প্রার্থীর চাকরি। সর্বত্র এরকম স্বজনপ্রীতি-স্বার্থপ্রীতির ওপর যদি আবার কোটা ব্যবস্থার মতো নিয়মের বাধাধরা থাকে তাহলে তো চাকরির শতভাগই নির্দিষ্ট শ্রেণি-গোষ্ঠির কোটায় সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তখন নাগরিক হিসেবে চাকরিতে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং সাধারনের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা আর থাকে না। থাকে না মেধা-যোগ্যতার সত্যিকার কোনো বাচবিচার। কোটা ব্যবস্থা বহাল ও রাজনীতিকরণের কারণে এবং উপযুক্ত মেধা-যোগ্যতার অভাবে বিচার, প্রশাসন সহ প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কতটা শূন্যতা তৈরি করছে তা দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। তাতে অনিয়ম, দুর্নীতির লাগাম টেনে যেমন ধরা যাচ্ছে না তেমনি সুবিচার ও সুশাসনের সংকট ক্রমেই দেশ ও সমাজকে বিরূপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে আমাদের আরো সোচ্চার ও সংঘবদ্ধ হবার সময় এসেছে। রাজনীতিক কি সামাজিক সবাইকে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে দাবি তুলে ধরা উচিত।

কোটা ব্যবস্থার ফলে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠির অঞ্চল হিসেবে কুমিল্লা জেলার তরুণ-যুবকরা শুধু বঞ্চিত হচ্ছেন তাই নয়, অন্যান্য জেলার মেধাবী, যোগ্যরাও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পুরো সুযোগ পাচ্ছেন না। কুমিল্লা জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে প্রতিবছর ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষিত হয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করছেন বলে জানা যায়। কিন্তু তাদের মাঝে সরকারি চাকরিতে সুযোগ পান, এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা একেবারেই নগন্য। প্রতিবছর শিক্ষাকাল সমাপ্তদের সরকারি বা বেসরকারি কোনো চাকরিতে সুযোগ পেতে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তারপরও কর্মপযুক্তের প্রায় অর্ধেক থেকে যায় উপযুক্ত কর্মসংস্থানের বাইরে। তাদের অধিকাংশরা চাকরি না পেয়ে বিদেশ বা ছোট-খাট ব্যবসা বাণিজ্য দিয়ে শুরু করেন জীবনের অনিশ্চিত যাত্রা। কুমিল্লা জেলার শিক্ষিত তরুনরা শ্রেণি ও জেলা কোটা এই দুই দিক থেকে চাকরির ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়েন।

কোটা ব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকটি বিশেষ কোটা মিলে সরকারি চাকরিতে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫৫ ভাগ কোটা সংরক্ষিত রাখা হয়। কোটাভুক্ত কেউ চাকরির আবেদন না করলে পদ শূন্য থাকলেও অন্য জেলার প্রার্থীদের এসব পদে সহসা নিয়োগ দেওয়া হয় না। বাকি ৪৫ ভাগ চাকরির পদে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সুপারিশ অগ্রাধিকারের পর যদি কোনো পদ অবশিষ্ট থাকে, তবে এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে অন্যান্য প্রার্থীদের জন্য চাকরির সম্ভাবনা। জেলা কোটাতে প্রত্যেক জেলার জন্য সমান সংখ্যক চাকরির সুযোগের নামে কুমিল্লা বেশি বঞ্চিত হচ্ছে। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১০/১৫ বছর আগে থেকেও যদি কুমিল্লার এক-দুই জন চাকরি করে থাকেন, তখন নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অজুহাতে কুমিল্লার চাকরি প্রার্থীরা আবেদনের অযোগ্য বিবেচিত হন। অন্যদিকে দেশের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও চাকরির জন্য যোগ্যতার সঙ্গে তদবির ও রেফারেন্স এক প্রকার কোটা হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে শিক্ষায় সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যাধিক্য থাকলেও প্রতিবছর চাকরিতে প্রবেশের অননিশ্চয়তায় থেকে যায় কুমিল্লার অনেক শিক্ষত তরুণরা।

এতে ব্যক্তি, পারিবারিক ও সমাজ জীবনে বৈষম্য-ব্যবধান যেমন বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্খায় হতাশা তৈরি করছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এভাবে মেধার চেয়ে কোটার নিয়ম বহাল থাকলে পিছিয়ে পড়বে কুমিল্লা। দেশের আরও অনেক জেলার যোগ্য, মেধাবীরাও বঞ্চিত হবেন উপযুক্ত চাকরির নিশ্চয়তা থেকে। এক সময় পেশায় হারিয়ে যাবে কৃতিদের কৃতিত্ব। সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হলে-স্বীকৃত, অস্বীকৃত আর কোনো কোটা নয়, কেবল যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতেই সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা দরকার।

লেখকঃ
আলী আকবর মাসুম
সাধারন সম্পাদক
সুজন, কুমিল্লা জেলা শাখা

আপনি চাইলে আপনার মুল্যবান মতামত লিখে পাঠাতে পারেন। আমাদের মেইলেঃ dailycomillanews@gmail.com

আরো পড়ুন