কুমিল্লার মেঘনায় পাপুলের স্ত্রীর ক্যাডারদের দাপটে কাঁদছে মানুষ!
সানাউল্লাহ, কাইয়ুম, মিলন, টুটুল, নিজাম ও ওয়াসিম। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম। এদের কেউ কেউ খুন, ধর্ষণসহ ১৫ থেকে ২০টি মামলার আসামি। বিএনপির ক্যাডার রাজনীতি থেকে ভোল পাল্টে এখন সবাই করছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী, কুমিল্লা সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই সন্ত্রাসীরা। সেলিনা ইসলাম মেঘনা উপজেলায় এলেই তাঁর চারপাশ ঘিরে থাকে এই ভয়ংকর ক্যাডার বাহিনী। মুদ্রা ও মানবপাচারসহ জালিয়াতির অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে থাকা পাপুলের স্ত্রী সেলিনার প্রত্যক্ষ মদদে এঁদের কেউ কেউ হয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। আর এঁদের হামলা-মামলায় কোণঠাসা আওয়ামী রাজনীতির নিবেদিত কর্মী-নেতারা।
একসময় হতদরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা সেলিনা ইসলাম স্বামীর মানবপাচার ও প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণার টাকায় আঙুল ফুলে হয়েছেন কলাগাছ। ২০১৮ সালে কুমিল্লা সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার আগে থেকেই তিনি মেঘনা উপজেলায় গড়ে তুলেছেন এই ক্যাডার বাহিনী, যারা খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণসহ চাঁদাবাজিতে মেতে রয়েছে। সেলিনা ও তাঁর ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নির্যাতনের শিকাররা কেউ মুখ খোলে না। সম্প্রতি সরেজমিন মেঘনা উপজেলায় গিয়ে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই ভয়াবহ চিত্র।
মেঘনা উপজেলার চালিভাঙ্গা গ্রামের সদর আলীর ছেলে মো. আবদুল্লাহকে বাঘ বাজার এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেলিনার ক্যাডার মো. সানাউল্লাহ ও আব্দুল কাইয়ুম মিয়ার নেতৃত্বে প্রকাশ্যেই দিনের বেলায় কুপিয়ে খুন করা হয় আবদুল্লাহকে। ওই দিন গুরুতর আহত হয়েছিলেন চালিভাঙ্গা গ্রামের রোশন আলীর ছেলে আব্দুল মান্নান, সদর আলীর ছেলে আলী হোসেন ও আমিন। ওই ঘটনায় নিহত আবদুল্লাহর বড় ভাই দিলবর আলী মেঘনা থানায় সানাউল্লাহ, কাইয়ুম মিয়াসহ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। সেলিনার ক্যাডাররা আব্দুল্লাহকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার বড় ভাই যুবলীগ নেতা আজগর আলী সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে এসে ছোট ভাই হত্যার প্রতিবাদ করায় দিনের বেলায় বাঘ বাজারে তাঁর একটি চোখও উপড়ে ফেলে দেয় তারা।
নিহত আব্দুল্লাহর স্ত্রী আমেনা বেগম ছেলে ইয়াসিন ও মেয়ে জাকিয়াকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করছেন। স্বামী হত্যার মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য তাঁর ওপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২০ লাখ টাকার মাধ্যমে আব্দুল্লাহ হত্যার আপসনামা করা হয়। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকা আমেনার পরিবার পেলেও বাকি ১০ লাখ টাকা কারা নেয় তিনি জানেন না। আমেনা বিলাপ করে এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘টাকা পেলেও আমার সন্তানরা তাদের বাবাকে কোনো দিন পাবে না, আমি পাব না স্বামীকে।’
আব্দুল্লাহ হত্যা মামলার আপসনামার বিষয়টি স্বীকার করে তাঁর বড় ভাই আজগর আলী বলেন, ‘আমার ভাইকে হত্যার পর মামলা করেছিলাম। ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলা আপসনামা করছিলাম। এখন সেই ঘটনা মনে করতে চাই না।’ আপনার এক চোখ টেঁটা দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে—এর জবাবে আজগর বলেন, ‘সেইটার মামলা এখনো আদালতে চলতাছে। ভাই, এই সব কথা কইলে আমরা ঝামেলায় পরমু।’
সানাউল্লাহ ও কাইয়ুমের খুন ও অপকর্মের আরো লোমহর্ষক কাহিনি রয়েছে। ফরাজিকান্দি গ্রামের আনোয়ার হোসেনকে তারা খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি, আনোয়ারের স্ত্রী নূর ভানুকেও ধর্ষণ করে এই ক্যাডার বাহিনী। ওই ঘটনায় আনোয়ার হোসেনের শ্বশুর নুরু মিয়া বাদী হয়ে সানাউল্লাহ, কাইয়ুমসহ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণ মামলা করেন।
২০১১ সালে চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের ওসমান আলীর ছেলে মুনসুর আলীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে কুপিয়ে খুন করে সানাউল্লাহ, কাইয়ুম মিয়াসহ ক্যাডাররা।
২০১৭ সালে চন্দনপুর ইউনিয়নের কাচেরকান্দি গ্রামের মো. মোহসিনের স্ত্রী মুক্তা আক্তারকে তাঁর বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে ফেলে রাখা হয়েছিল। ওই ঘটনায় জড়িত জেলা যুবলীগের সদস্য মেঘনা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মিলন সরকার, জামান মেম্বারসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় জেল খাটেন মিলন সরকার। ২০১৬ সালে ১১ জুন মিলন সরকারসহ ক্যাডারা মেঘনা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গাজী মো. দেলোয়ার হোসেনকে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে দিয়েছিলেন। গুরুতর আহত হয়ে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেন দেলোয়ার। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে থাকায় বিএনপি-জামায়াতের হামলা-মামলার শিকার হয়েছিলেন এই নেতা। এরপর আওয়ামী লীগের আমলেই নির্যাতনের শিকার হন। হামলার বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সেই দিন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলাম, বিএনপির আমলে হামলা-মামলা খেয়ে এলাকাছাড়া ছিলাম। আওয়ামী লীগের আমলেও আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়।
একই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও থানা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আমীনকে ২০১৮ সালে বাড়িতে গিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারে ক্ষমতায় আমাদের আওয়ামী লীগ, কিন্তু আমরা এলাকাছাড়া হয়ে থাকি। এই কষ্টের কথা কাকে বলব? কে সমাধান দেবে? ২০১০ সালে বড়কান্দা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মাজাহারুল হকের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পিটিয়ে আহত করে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে সম্রাটসহ সেলিনা ইসলামের ক্যাডাররা।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেঘনা উপজেলার বড়কান্দা ইউনিয়নের সোনাকান্দা গ্রামের মজিবুর রহমানের মেয়ে সেলিনা ইসলাম। মজিবুর রহমান ছিলেন দিনমজুর। অভাবের কারণে মেয়ে সেলিনাকে লেখাপড়াও করাতে পারেননি। নব্বইয়ের দশকে পাঠিয়ে দেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে। সেখানেই পরিচয়ের সূত্রে সেলিনার সঙ্গে বিয়ে হয় কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়া বর্তমানে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের। পরবর্তী সময়ে মানবপাচার ও প্রবাসী শ্রমিকদের ঠকিয়ে তাঁরা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন হাজার কোটি টাকার মালিক। দেশে এসে স্বামীর পাশাপাশি কুমিল্লা থেকে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য হয়ে যান সেলিনা ইসলাম।
সংসদ সদস্য হওয়ার আগে ২০০৯ সাল থেকে মেঘনা উপজেলায় ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করেন সেলিনা ইসলাম। ক্যাডার বাহিনী নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন উপজেলায়। মেঘনা উপজেলার নলচর গ্রামের মৃত আক্কাস আলী মেম্বারের ছেলে মো. সানাউল্লাহ এমনই একজন ভয়ংকর ক্যাডার, যার বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যাসহ ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থেকেও শুধু সেলিনার হাত ধরেই সানাউল্লাহ হয়ে যান চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক এবং পরবর্তী সময়ে সভাপতি।
একইভাবে চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের আব্দুল কাদের মিয়ার ছেলে কাইয়ুম মিয়ার বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা, ধর্ষণসহ ১৪টি মামলা রয়েছে। কাইয়ুম একসময় ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। তাঁর বাবা আব্দুল কাদের মিয়া বর্তমানে চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। ২০১২ সালে চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন কাইয়ুম।
সেলিনা ইসলামের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, প্রায় বলতে গেলে জোর করেই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সদস্য হন মিলন সরকার। মেঘনা উপজেলাসহ আশপাশের উপজেলায় দুর্ধর্ষ হাবিবুল্লাহ ডাকাতের ছেলে শফিকুল ইসলাম দেওয়ান। শফিকুল এখন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামের খালাতো ভাই মো. ওয়াসিম ও মানিক্যারচর গ্রামের মাজেদুল ইসলাম টুটুলসহ সেলিনার ক্যাডাররা উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে।
নির্যাতনের শিকার মেঘনা উপজেলার মানুষ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ২০০৯ সালের পর থেকে স্বামী পাপুলসহ সেলিনা ইসলাম এলাকায় যাতায়াত শুরু করলে তাঁদের চারপাশে ধীরে ধীরে ভিড়তে থাকে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনীসহ স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে সেলিনার প্রত্যক্ষ মদদে কাইয়ুম, সানাউল্লাহ, মিলন সরকার, জাহাঙ্গীর, নিজাম, ওয়াসিম, টুটুলসহ সন্ত্রাসীরা মেঘনা উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সেলিনা ইসলামের অনুপস্থিতিতে সন্ত্রাসীদের মাঠে থেকে মদদ দেন তাঁরই ছোট বোন ইয়াসমিন প্রধান।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে সেলিনা ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিন ফোনকল রিসিভ করেননি, এসএমএস করা হলেও কোনো জবাব দেননি। এরপর তাঁর ছোট বোন ইয়াসমিন প্রধানের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সানাউল্লাহ-কাইয়ুমদের আমরা নাম শুনেছি, হয়তো আমাদের বাড়িতেও এসেছে; কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো সখ্য নেই। আর রাজনীতি করতে গেলে চোর-বাটপার, সন্ত্রাসী, খারাপ লোক কোনো সময় আমাদের মাঝে চলে আসে সেটা তো সব সময় খেয়াল রাখা যায় না। আমার বোনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, অনেকেই এখন মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছেন।’
সূত্রঃ কালেরকন্ঠ