কুমিল্লায় ৭ তলার ওপরে নেই আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা
ধারণক্ষমতার তিন গুণ মানুষের বসবাস কুমিল্লা নগরীতে। বেশির ভাগ এলাকায় নেই প্রশস্ত সড়ক। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লাগে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় লাগাতার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কুমিল্লা নগরীর বাসিন্দারাও।
কুমিল্লা নগরীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে ও বিভিন্ন উপজেলায় খবর নিয়ে জানা গেছে, গ্রামের তুলনায় কুমিল্লা শহরের অগ্নিঝুঁকি কয়েক গুণ বেশি। কারণ শহরের ভবনগুলো গ্রামের তুলনায় খুবই ঘেঁষা, যা নিয়মের বাইরে গিয়েও নির্মাণ করা। এ কারণে শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত হিসেবে।
শহরের কান্দিরপাড়, ঝাউতলা, রাজগঞ্জ, মনোহরপুর, পানপট্টি, তেরিপট্টি ও আশপাশের এলাকা, ঠাকুরপাড়া, টমছমব্রিজ, মোঘলটুলি, রেলস্টেশন, শাসনগাছা, চৌধুরীপাড়া, গর্জনখোলা, শহর লাগোয়া ধর্মপুর, দৌলতপুর, নোয়াপাড়া, এলাকার বেশির ভাগের নেই প্রশস্ত সড়ক। এতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলের পাশে গেলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লাগে৷ কখনও তা ঘটণ্টাখানেকও লাগতে পারে। তখন আগুন নেভাতেও সময় প্রয়োজন হয়।
এদিকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কান্দিরপাড়, রাজগঞ্জ, চকবাজার, নিউমার্কেট, ছাতিপট্টিসহ আশপাশের এলাকা। এসব এলাকায় গাড়ি তো দূরে, মানুষও হাঁটা দুষ্কর।
নগরীর রাজগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা তানভীর দীপু বলেন, ফায়ার সার্ভিস যদি ঘটনাস্থলে যায়, তাহলে তো আগুন নেভাতে পারবে। যদি যেতে না পারে, তাহলে কীভাবে আগুন নেভাবে? ব্যবসায়িক কারণে এ নগরীর গুরুত্ব বহুকাল ধরে আছে। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা কতটা উন্নত হয়েছে, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
দীপু বলেন, এ শহরের সড়কের কোনও প্রশস্ততা নেই। সেই সড়কই আবার দখল। যেখানে মানুষই হাঁটতে বেগ পায়, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কীভাবে যাবে! তা ছাড়া গলির পর গলি এ শহরের মানুষকে আতঙ্কিত করছে দিন দিন। একবার আগুন লাগলে কীভাবে নেভাবে, তা কেউ জানে না। কুমিল্লায় শিগগিরই পরিকল্পিত নগরায়ণ প্রয়োজন। না হয় যেকোনও সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, কুমিল্লা এখন অন্যতম অগ্নিঝুঁকির শহর। তারা বলছে, এর নেপথ্যে রয়েছে নানা কারণ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, সরু রাস্তা ও গলি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যানজট, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার, পুকুর ও দিঘি ভরাট, পানির উৎস না থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, ফায়ার সার্ভিসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা ও পর্যাপ্ত জনবল না থাকা।
সূত্র আরও বলছে, কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মাত্র ১৩টিতে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। বাকি উপজেলাগুলোয় ফায়ার স্টেশন স্থাপনের চেষ্টা চলছে। যেগুলোতে আছে, সম্পূর্ণ সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার সব স্টেশনে আছে জনবল-সংকট ও পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদির সংকট।
কুমিল্লা জেলার ফায়ার সার্ভিসে আছে তিনটি ইমার্জেন্সি রেসকিউ টেন্ডার (ইটি) এবং আরও দুটি অনুমোদন হয়েছে। ওয়াটার টেন্ডার ১৭টি, একটি স্নোরকেল (বহুতল ভবনের আগুন নেভানোর মেশিন), প্রতি স্টেশনে আছে অ্যাম্বুল্যান্স ও একটি রেকার ভ্যান, ২৭টি পানির পাম্প, একটি কনটেইনার, আটটি ফোম টেন্ডার, ৩৭টি মোটরবাইকসহ অন্যান্য সরঞ্জাম, যা একটি জেলার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তবে এর মাঝে সবচেয়ে বেশি সংকট জনবলে। কুমিল্লা জেলায় প্রায় ১৫০ জনের জনবল সংকট রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংকট আছে শহরের ফায়ার স্টেশনে।
ওই সূত্রটি বলছে ফায়ার সার্ভিসের কাজের সর্ব প্রথম বাধা কুমিল্লা নগরীর যানজট, উৎসুক জনতা ও সরু গলি। এ ছাড়াও রয়েছে পুকুর ও দিঘি ভরাট করা।
অগ্নিকাণ্ডে কুমিল্লার ফায়ার সার্ভিসের চ্যালেঞ্জ কী, এমন প্রশ্নে কুমিল্লার ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা কুমিল্লা শহরের ৭ তলা পর্যন্ত ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সক্ষম। অথচ এই শহরে ১০ তলার ওপরেও ভবন আছে। ৭ তলার ওপরের ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে এখনও আমাদের কাছে কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে আমরা সরঞ্জামের জন্য আবেদন করেছি। এ ছাড়া যদি দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা খবর পাই অবশ্যই আমরা সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো।
তবে সড়কে যানজট থাকলে আমরা সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারি না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি শহরের অনেক দিঘি ভরাট হয়ে গেছে, তাই ঘটনার পর পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। আরেকটি বিষয় উৎসুক জনতা। এদের কারণে আমরা কাজ করতে বাধগ্রস্ত হই। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এসব কারণে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক হতে পারে। এ ছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, সরু গলি হওয়ায় আমরা ঘটনাস্থলের কাছে গিয়েও কিছু করার থাকে না। আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে যেতে পারে না।
কুমিল্লার আগুন বঙ্গবাজারকে হার মানাবে উল্লেখ করে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি রোকেয়া বেগম শেফালী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বঙ্গবাজারে কী হয়েছে! কুমিল্লায় অগ্নিকাণ্ড হলে আরও ভয়াবহ হতে পারে। এই শহরের পরিকল্পিতভাবে নেই। এক ভবনের সঙ্গে আরেকটি ভবন লাগানো।
নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড়ের মার্কেটগুলোর কথা ইঙ্গিত করে বেগম শেফালী বলেন, এগুলো সব একসঙ্গে লাগানো। আল্লাহ না করুন যদি আগুন লেগে যায়, তাহলে সব একসঙ্গে পুড়বে। কারণ এখানে ফায়ার সার্ভিস ঢোকারও কোনও রাস্তা নেই।
তিনি বলেন, আমার ভবনের একজনও জানেন না আগুন লাগলে কীভাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। ফায়ার সার্ভিসের উচিত মানুষকে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। পরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও নির্মাণের পর ভবনের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, তা নিয়মিত তদারকি করা। না হয় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ফায়ার সার্ভিসের সংকট নিরসনে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি, এমনটি উল্লেখ করে কুমিল্লার ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন বলেন, ভবন নির্মাণ আইন অনুযায়ী ভবনের পাশে ৫ ফুট করে খালি রাখতে হবে। এ ছাড়া ভবনের সামনে ২০ ফুট জায়গা রাখতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ভবনে তা নেই। তাই কুমিল্লা একরকম অপরিকল্পিত নগরী। প্রচুর যানজট, মানা হয় না ভবন নির্মাণ আইন। পর্যাপ্ত রাস্তা রাখা হয় না।
তিনি আরও বলেন, আমরা কুমিল্লা নগরীর বহুতল ভবনে প্রতি সপ্তাহে দুটি করে অভিযান করি। এতে কোনও ভবনে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকলে আমরা তাকে নোটিশ দিই। তা না মানলে আইনি ব্যবস্থার ঘোষণা দিই। আমরা সভা সেমিনার করি। সতর্কতামূলক প্রদর্শনী করি। তা ছাড়া আমাদের সংকট নিরসনে আরও সরঞ্জামের জন্য চাহিদা দিয়েছি, জনবলের জন্য চাহিদা দিয়েছি। সেগুলো এলে আমাদের আরও পরিপূর্ণতা আসবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, বর্ষা এলেই আমাদের স্টেশনটি পানিতে ডুবে যায়। আমাদের অনেক মেশিন ও চলাচলে বেগ পেতে হয়। এটি বর্ষাকালীন সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এর জন্যও আবেদন করেছি। আশা করি শিগগিরই তা সমাধান হবে।