‘৩ জন মিলে গুলি করে হত্যার পর ফেনসিডিল খাই’

কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরপুর বাজারে আলোচিত যুবলীগ নেতা জামাল হোসেন হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন দেলু। সে বোরকা পরে গুলি করে যুবলীগ নেতাকে হত্যা করা তিন ব্যক্তির একজন। দেলু আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বর্ণনা দিয়েছে সেই হত্যাকাণ্ডের।

হত্যাকাণ্ডের দিন সন্ধ্যায় দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই মাসুদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে তারা। কালো মাইক্রো বাসযোগে পরিকল্পনা মতো গৌরীপুর বাজারে বোরকা পরে যায় আরিফ, কালা মনির ও দেলু। বাজারে জামালকে পাওয়া মাত্র মনির ও আরিফ দুইটা করে গুলি করে। শেষে একটা গুলি করে দেলু। তখন পরিকল্পনা মতো দৌঁড়ে প্রথমে সিএনজিতে করে, পরে মাইক্রোবাসে উঠে চান্দিনার কাঠেরপুল এলাকায় চলে যায় হত্যাকারীরা। সেখান থেকে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মাসুদ অন্য একটি হাইসে করে তাদের নিয়ে যান নোয়খালীর সূবর্ণচরে। নোয়খালীতে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের মুরগীর ফ্যাক্টরিতে আত্মগোপন করে তারা।

দেলোয়ার হোসেন দেলু আদালতে তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘দাউদকান্দিতে জমি বিক্রি ও দালান উঠানোর চাঁদা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় জামাল-কামাল ও সুজন-শাকিল দুই গ্রুপের মধ্যে। এগুলো নিয়ে মারামারিও হয় কয়েক দফা। পরে দশ লাখ টাকা চুক্তিতে জামালকে হত্যার পরিকল্পনা করে প্রতিপক্ষ। এই বিষয়ে সোহেল সিকদারসহ আরো কয়েকজন সহায়তার কথা বলেন। ৩০ এপ্রিল বিকেলে জিয়াকান্দি পাওয়ার হাউস থেকে একটি মাইক্রোবাসে উঠে আরিফ, মনির ও আমি বোরকা পরি। গাড়িটি আমাদের নিয়ে ঘন্টা খানেক ঘুরাঘুরি করে আবার পাওয়ার হাউসে চলে আসে। সেখানে আরিফ আমাকে একটি ও মনিরকে একটি বন্দুক দেয়। তার কাছে রাখে আরো একটি। সেখান থেকে সিএনজিতে করে গৌরীপুর বাজারে চলে যাই। গৌরীপুর বাজারে আমাদের লোক জামালের অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। সন্ধ্যা নাগাদ তথ্য দেওয়া জায়গায় জামালকে দেখা মাত্র আরিফ ও কালা মনির দু’টি করে গুলি করে। শেষে আমি একটি গুলি করি। লোক জড়ো হতে থাকলে আমরা দৌঁড়ে ভুলির রাস্তা মাথায় চলে যাই। সেখান থেকে জঙ্গল দিয়ে মোক্তারের গ্যারেজের কাছে গেলে শাহ আলী হাইস গাড়ি নিয়ে আসে। আমরা চান্দিনা কাঠেরপুল এলাকায় গিয়ে দেখি দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই মাসুদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেছে। সে গাড়িতে উঠলে আরিফ বলে ‘জামাল শেষ’। তখন মাসুদ বলে ঠিক আছে। আমরা গাড়িতে করে আশ্রমের পাশে গেলে মাসুদ সৈকতকে দিয়ে ৫টা ফেন্সিডিল আনে। আমরা সবাই মিলে খাই। মাসুদ অস্ত্রের ব্যাগ সৈকতের কাছে দিয়ে বলে তার বাড়িতে রেখে আসতে। আমাদের মোবাইল গুলো পলিথিনে করে ফখরুলের কাছে রেখে যাই। সেখান থেকে মাসুদসহ আমরা নিমসার বাজার এলাকায় চলে যাই। ওখানে মাসুদ ফোন করে অন্য একটি হাইস নিয়ে আসে। সেই হাইস করে মাসুদসহ আমরা নোয়াখালীর সূবর্ণচরে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের মুরগীর ফ্যাক্টরিতে চলে যাই। ফ্যাক্টরিতে গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরে আমি শনিরআখড়া আমার খালার বাড়িতে চলে যাই। সেখান থেকে র‌্যাব আমাকে গ্রেফতার করে’।

জামাল হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এড. মাসুদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘আদালতে দেলু, সৈকত ও গাড়ি চালক সুমন স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এতে মাসুদসহ পেছনের সকল মাস্টার মাইন্ডের কথা বেড়িয়ে এসেছে৷ আমরা আশা করবো মহামান্য আদালত মাস্টার মাইন্ডসহ সকলের সর্বোচ্চ শাস্তি দিবেন ‘।

দাউন্দকান্দি যুবলীগ নেতা জামাল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শ্যুটার দেলুসহ আরো দুইজন আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অপর দুইজন হলো হাইস গাড়ি চালক সুমন হোসেন ও একই ঘটনায় অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম সৈকত। গাড়ি চালক সুমন হোসেন গাড়িতে করে আসামীদের বহন করার কথা আদালতে স্বীকার করেন। অপর দিকে ছাত্রলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম সৈকত মাসুদের বাড়িতে অস্ত্রের ব্যাগ হত্যা শেষে পৌছে দেওয়া ও পরবর্তীতে মহাসড়কের পাশে লোকিয়ে রাখার বিষয়টি স্বীকার করেন। এখন পর্যন্ত জামাল হত্যাকা-ের ঘটনায় র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ১০ জন গ্রেফতার হয়েছে।

কুমিল্লা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি রাজেস বড়ুয়া জানান, ‘আমরা গভীর ভাবে এই ঘটনার তদন্ত করছি। আসামীরা আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক বক্তব্য দিয়েছে। আশা করি জামাল হোসেন হত্যাকা-ের সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য বেড়িয়ে আসবে’।

প্রসঙ্গত, কুমিল্লা দাউদকান্দির গৌরিপুর বাজারে গত ৩০ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন খুন হন। তিনজন বোরকা পরে এসে তাকে গুলি করে হত্যা করেন।

নিহত জামাল হোসেন তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে। তিতাস উপজেলায় বাড়ি হলেও তিনি ব্যবসায়িক সূত্রে পাশের দাউদকান্দি উপজেলার গৌরিপুর বাজারের পাশে ভাড়া বাসায় থাকতেন।মাজহারুল ইসলাম সৈকত বরকামতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের অনুসারী। চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মাসুদ যুবলীগ নেতা জামাল হোসেন হত্যা মামলার ১০ নাম্বার আসামী।

আরো পড়ুন