কুমিল্লায় অবৈধ লেভেলক্রসিং ঘটছে দুর্ঘটনা, মরছে মানুষ
ডেস্ক রিপোর্টঃ পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের ‘প্রবেশদ্বার’ কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন। এর আওতায় রয়েছে ১৮৪ কিলোমিটার রেলপথ। ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম, লাকসাম-নোয়খালী ও লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথের এই ১৮৪ কিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে লাকসাম রেলওয়ে থানা পুলিশও। এই বিশাল রেলপথে রয়েছে ২০০টির বেশি লেভেলক্রসিং। যদিও স্থানীয় সূত্রের দাবি, এই সংখ্যা হবে দ্বিগুণের বেশি। তবে লেভেলক্রসিংয়ের সঠিক হিসাব নেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছেও।
আশ্চর্যের বিষয়, ওইসব লেভেলক্রসিংয়ের প্রায় ৯০ শতাংশই অনুমোদনহীন বা অবৈধ। এসব স্থানে গেট বা গেটম্যান নেই এবং এগুলো অরক্ষিত। সাধারণ মানুষের কাছে এই লেভেলক্রসিংগুলো এখন ‘মরণফাঁদ’ হিসেবে পরিচিত। জানা গেছে, এই লেভেলক্রসিংগুলোয় ট্রেনের ধাক্কায় বা চাকায় কাটা পড়ে গত দুই বছরে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১০০ মানুষ। সর্বশেষ গত সোমবার লাকসাম পৌর শহরের ফতেপুরে গেটম্যানবিহীন একটি লেভেলক্রসিংয়ে ডেমু ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশাচালক মো. হৃদয় মিয়ার (৩০) মৃত্যু হয়। এসব লেভেলক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সাড়া নেই বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের।
লাকসাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওসমান গণি পাঠান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে লাকসাম থেকে কুমিল্লার সীমান্ত এলাকা শালদা নদী, লাকসাম থেকে ফেনী, লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথে নোয়াখালী আর লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে চাঁদপুরের আউটার সিগন্যাল পর্যন্ত ১৮৪ কিলোমিটার রেলপথ এলাকা আমাদের আওতাধীন। তবে এর মধ্যে কতগুলো লেভেলক্রসিং আছে এর সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই।’
তবে লাকসাম রেলওয়ে জংশন ও রেলওয়ে থানার একাধিক সূত্র জানায়, লাকসাম রেলওয়ে জংশনের আওতাধীন ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম রেলপথে ৬৮টি, লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথের আউটার সিগন্যাল পর্যন্ত একটি এবং লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথে ৪৮টিসহ ১১৭টি লেভেলক্রসিংয়ের হিসাব রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৪টি লেভেলক্রসিং বৈধ। তবে এই ৩৪টির বেশ কয়েকটিতেও নেই গেট ও গেটম্যান। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এসব স্থানে নিজ দায়িত্বে পারাপারের জন্য সতর্কবার্তা লিখে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। তবে অরক্ষিত কয়েকটি রেলক্রসিংয়ে সতর্কবার্তা থাকলেও থামছে না দুর্ঘটনা। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি রেললাইনের লেভেলক্রসিংসংলগ্ন ভূমি দখল করে বাড়িঘর, দোকান নির্মাণ করায় পথচারী ও যানবাহন চালকদের ট্রেন চলাচল চোখে পড়ে না। এতে রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে প্রাণহানিসহ দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের অসাবধানতার জন্যও লেভেলক্রসিংয়ে প্রাণহানিসহ বিভিন্ন যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়ে।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের লাকসাম থেকে মিরসরাইয়ের চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ডাবল রেললাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এ পথে আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে ও দ্রুতগতিতে ট্রেন চলে। ৬১ কিলোমিটারের এ পথে বেশির ভাগ লেভেলক্রসিংয়ে গেট নেই। এতে এলাকাবাসী ও পথচারীরা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছে।
লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল রেলপথে নাঙ্গলকোট পৌর বাজারে অবস্থিত অবৈধ লেভেলক্রসিং দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী বিল্লাল হোসেন রিয়াজ, দুলাল মিয়াসহ এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও পথচারী জানান, এই লেভেলক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার গাড়ি চলাচল করে। এ ছাড়া শিশু, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আসা-যাওয়া করে। কিন্তু দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ এই লেভেলক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ বা গেটম্যান নিয়োগ করা হয়নি। অথচ কিছুদিন পরপরই এখানে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মরছে। লাকসামের আজগরা এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় দুটি লেভেলক্রসিং খাকলেও একটিরও গেট বা গেটম্যান নেই। তাই এ স্থানে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে।’
লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, লাকসাম রেলওয়ে দেড় শ-দুই শ লেভেলক্রসিংয়ের কথা বললেও এর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে চলাচল করছে। এতে এই সংখ্যা বাড়ছে।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১ এপ্রিল ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে নাঙ্গলকোটের হাসানপুর স্টেশন এলাকার অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মাদরাসা শিক্ষক মাওলানা হাছান আহমেদ (৩৭) নিহত হন। অবৈধ লেভেলক্রসিং পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে ও ট্রেনের ধাক্কায় ১৭ মার্চ নাঙ্গলকোট পৌর বাজারে দুই পথচারী আবদুল আলীম (৪৫) ও আবুল কাসেম (৫০), ১৪ মার্চ চৌদ্দগ্রামের শুনবতী এলাকায় অজ্ঞাতপরিচয় যুবক (২৮), ৩ এপ্রিল নাঙ্গলকোটে মিনি বেগম (৪০), ১৭ আগস্ট নাঙ্গলকোটে অটোরিকশাচালক আমির হোসেন অনু (২৫) ও ২ নভেম্বর লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে মো. শওকতের (২৫) মৃত্যু হয়। সূত্র মতে, এগুলো গত বছর ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সিকিভাগ মাত্র। আর গত দুই বছরে শুধু লাকসাম রেলওয়ের আওতাধীন এলাকাতেই এই মৃত্যুর সংখ্যা হবে অন্তত ১০০। কারণ, অনেক সময় দুর্ঘটনা বা হতাহতের খবর রেলওয়ে পুলিশের কাছে পৌঁছায় না। স্থানীয়রাই লাশ উদ্ধার করে সৎকার করে ফেলে।
গত বুধবার এ প্রসঙ্গে জানতে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পরিবহন পরিদর্শক মো. আবু তাহেরের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়। তিনি একবার ফোন ধরে কেটে দেন। তবে লাকসাম রেলওয়ে থানার ওসি ওসমান গণি পাঠান বলেন, ‘আমরা প্রতিটি মিটিংয়ে বিষয়টি তুলে ধরছি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।’ তিনি জানান, প্রতিটি বা গুরুত্বপূর্ণ লেভেলক্রসিংগুলোতে গেট নির্মাণ করে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হলে এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা অসম্ভব কিছু নয়।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ