কুমিল্লায় পার্কে মৃত্যু আতঙ্ক, দোষীদের বিচারের দাবি
মাসুদ আলমঃ কুমিল্লা নগরীর পার্কগুলো নিয়ে বিনোদনপ্রেমীদের মাঝে মৃত্যু আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঈদের ছুটিতে রাইডে চড়তে গিয়ে দুই পার্কে দুই কিশোরের মৃত্যু নিয়ে তাদের মধ্যে এই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব রাইড পরিত্যক্ত লোহার টুকরো, পুরনো অ্যালুমিনিয়ামের পাত ও জাহাজ ভাঙার লোহা দিয়ে স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরি করা হয়েছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নগর উদ্যানে ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় পার্কে শান্তা মরিয়ম রাইডে (নৌকা রাইড) চড়তে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কলেজছাত্র মো. রায়হানের (২০) মৃত্যু হয়। রায়হান নগরীর ছোটরা এলাকার বাবুল মিয়ার ছেলে। সে সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই কলেজের ছাত্র ছিল। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কলেজছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় কুমিল্লা জেলা প্রশাসন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর ২৭ আগস্ট কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের ম্যাজেস্ট্রেট জেলা প্রশাসকের নির্দেশে কুমিল্লা নগর উদ্যান, ফান টাউনসহ একাধিক পার্কে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে কুমিল্লা নগর উদ্যানে নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি রাইড, ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈধ্য বিদ্যুৎ সংযোগ এবং অপরিকল্পিত লাইটিং অপসারণ করেন।
এরপর গতকাল বুধবার কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে নগর শিশু উদ্যান পার্কে বন্ধুদের সাথে রাইডে চড়তে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত কলেজ ছাত্র রায়হানের মৃত্যুতে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে রায়হানের পরিবার, এলাকাবাসী এবং সচেতন কুমিল্লা মহানগরবাসী।
এরআগে ঈদের দিন (২২ আগস্ট) সদর দক্ষিণ উপজেলায় ড্রিমল্যান্ড পার্কে এক কিশোর নাগরদোলায় চড়ার সময় সেখানে ঝুলে থাকা দড়ির সঙ্গে তার গলা পেঁচিয়ে ফাঁস লেগে মৃত্যু হয়। নিহত শিশু তানিম (৮) নগরীর ভাটপাড়া গ্রামের জসিম উদ্দিন খানের ছেলে। সে ওই এলাকার একটি মাদরাসার ২য় শ্রেণির ছাত্র ছিল। নিহতের বাবা জসিম খান বাদী হয়ে সদর দক্ষিণ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ড্রিমল্যান্ড পার্কের মালিক সাইদুর রহমান শাহিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
কুমিল্লা নগরীর ঢুলিপাড়ায় ফান টাউন, সুয়াগাজী ড্রিমল্যান্ড পার্ক, লালমাই পাহাড়ে ব্লু-ওয়াটার পার্ক, লালমাই লেকল্যান্ড ও ডাইনোসর ড্রাগন পার্ক গড়ে উঠেছে। নগরীতে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা এসব পার্কেও রাইড রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নগর শিশু উদ্যান পার্ক এবং সুয়াগাজি ড্রিমল্যাড পার্কের মতো কুমিল্লার অনেক পার্কের রাইডগুলোও ত্রুটিপূর্ণ।
সূত্র আরো জানায়, ওই দিন সন্ধ্যায় কিশোরটি ড্রিমল্যান্ড পার্কে একটি নাগরদোলায় চড়ার সময় সেখানে ঝুলে থাকা একটি দড়ির সঙ্গে তার গলা পেঁচিয়ে যায়। ওই সময় ফাঁস লেগে তার মৃত্যু হয়। পার্ক কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় নাগরদোলায় কিশোরের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়।
এদিকে ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় নগরীর ধর্মসাগর দিঘীর উত্তর পাড়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নগর উদ্যানে কয়েকজন বন্ধু মিলে নগর উদ্যানের নৌকা রাইডে চড়ে। পরে রায়হান নৌকা রাইডে বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত হয়। বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক রায়হানকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঋষি দাস নামে একজন বলেন, নগর শিশু উদ্যান পার্ক এবং সুয়াগাজি ড্রিমল্যাড পার্কের মতো কুমিল্লার অন্যান্য পার্কের রাইডে চড়তে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটবেনা এমন নিশ্চয়তাকে দেবে। সবগুলো পার্কে গিয়ে রাইডগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হোক।
নগর শিশু উদ্যানে ৩০টির বেশি রাইড রয়েছে। সবগুলো একেকটি মরণ ফাঁদ বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার পুলিশ সুপার। ২৬ আগস্ট তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এ কথা জানান।
পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে নৌকার রাইডটি তৈরি করা হয়। রাইডটি বিদ্যুৎ নয় জেনারেটরের মাধ্যমে চালানো হয়েছিল। নৌকার এই রাইডসটিতে জেনারেটর থেকে ৪শ ভোল্টের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ হতো। অত্যন্ত হাই পাওয়ার বোল্টের জেনারেটরটির বৈদ্যুতিক ক্যাবল ছিল খুবই নিম্নমানের। ক্যাবলগুলো থেকে তার বেরিয়ে থাকতে দেখা গেছে। মাটিতে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যারা দায়িত্বে ছিলেন আমরা প্রাথমিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা নিয়েছি। এর বাইরে কারও কোনও দায়িত্বের অবহেলা আছে কিনা পুলিশ তদন্ত করছে। দায়িত্বে গাফিলতি থাকলে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশ সুপার বলেন, কুসিকের নগর শিশু উদ্যান ছাড়াও কুমিল্লার আরও একাধিক পার্ক রয়েছে। যেগুলোতে ইলেকট্রিক রাইড রয়েছে। আমরা এই মামলার তদন্তের মাধ্যমে অন্যান্য পার্কগুলোর পরিচালকদেরকে একটি মেসেজ দেবো। যেন বিনোদন প্রিয় শিশু, কিশোর ও মানুষজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। তা নাহলে আর কোনও ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনজুর কাদের মনি বলেন, নগর শিশু উদ্যান পার্কটি আমার ওয়ার্ডে পড়েছে। পার্কটি নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও সব কথা বলা সম্ভব হয় না। পার্কটির রাইডগুলো সম্পর্কে মেয়র খুব ভালো বলতে পারবে। কারণ তাদের অনুসারীরাই পার্কটি দেখাশুনা করে।
২৫ আগস্ট নগর শিশু উদ্যানে কলেজছাত্রের মৃত্যুর পর রাইড পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শরিফ এবং কাসেম পালিয়ে যায়। তারা দুই জনই কুসিকের পিয়ন (অস্থায়ী নিয়োগ) বলে জানিয়েছেন কুসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম বড়ুয়া ।
২৬ আগস্ট কুমিল্লা কোতয়ালী মডেল থানায় রায়হানের বাবা বাদী হয়ে শরিফ ও কাসেমের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাইডের প্রত্যেকটি জোড়া ঝালাই করা। ৪শ ভোল্টের জেনারেটরে চালিত নৌকা রাইডটি ছিল একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ। বৈদ্যুতিক তারগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। বিদ্যুতের লাইন এদিক-সেদিক এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পার্কের ল্যাম্পগুলো ভাঙা। বিদ্যুতের তারগুলো হা করে তাকিয়ে আছে।
ডাইনোসর ড্রাগন পার্কের পরিচালক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ড্রাগন পার্ক বাংলাদেশের একমাত্র পার্ক, যার সবগুলো রাইড দেশের বাইর থেকে আনা হয়েছে। ড্রাগন পার্কে দেশে তৈরি কোনও রাইড নেই। আমরা সকাল-সন্ধ্যা দুই বেলা রাইডসগুলো পরীক্ষা করে থাকি। আমার জানা মতে কুমিল্লার আর কোনও পার্কে বিদেশ থেকে আনা রাইড নেই।
নিহত কলেজছাত্র রায়হানের বাবা মো. বাবুল মিয়া বলেন, রায়হানের সঙ্গে আরও তিন জন আহত হয়। রায়হান গুরুতর আহত হলে তার বন্ধুরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে আমি রায়হানকে মৃত পড়ে থাকতে দেখি। সিটি করপোরেশন আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি চাই না সিটি করপোরেশনের এই পার্কে এসে আর কারও মা-বাবার বুক খালি হোক। আমি প্রশাসনের কাছে এই হত্যাকা-ের বিচার চাই।
কুসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম বড়ুয়া বলেন, ‘পার্কে রাইড বসানোর জন্য কুসিকে আবেদন করতে হয়। পরে আমাদের কর্মরত প্রকৌশলীরা যাচাই-বাছাই করে জায়গা নির্ধারণ করে দেয়। পার্ক সিটি করপোরেশনের হলেও রাইডের মালিক কুসিক না। তবে কুসিক পার্ক দেখাশুনা করে থাকে।
নিম্নমানের যন্ত্রাংশ এবং বৈদ্যুতিক তার দিয়ে তৈরি রাইডে চড়তে গিয়ে মৃত্যুর কারণ এবং রাইডসের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, পার্কে রাইডে চড়তে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কলেজছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা শুনেছি। রাইডের মান সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। পার্ক আমরা দেখাশুনা এবং উন্নয়ন করে থাকি। যেকোনও ব্যক্তি পার্কে রাইড বসাতে আবেদন করলে আমরা যাচাই-বাছাই করে অনুমতি দিয়ে থাকি। রাইডগুলো তারা ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানি থেকে এনেছে। একেকজন একেক কোম্পানি থেকে। আমরা সবগুলো রাইড মালিকদের সঙ্গে বসবো। কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করবো।