কুমিল্লা স্টেডিয়ামে চলছে হাউজির নামে জুয়া, নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লা ষ্টেডিয়ামে এখন চলছে হাউজির নামে বড় ধরনের জুয়া। আর হাউজির নামে হাউজির পরিচালক প্রতিদিনই কুমিল্লা থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। এই খেলায় কয়েকজন লোক লাভবান হলেও ৯৯% লোক হন আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ। স্টেডিয়াম যেখানে চর্চা হবার কথা ছিল শারিরিক খেলাধুলা। কুমিল্লা স্টেডিয়ামে খেলাধূলার চর্চা কমেছে বেশ অনেক বছর ধরেই,তবে এখন বেড়েছে বিশাল হাউজি খেলা। হাউজি খেলাকে অনেকে জুয়াও বলে থাকেন। আগেও হাউজি খেলা হতো তবে সেটা ছিল সহনীয় ও বিনোদনের মধ্যদিয়ে । এখন সেটি আর সহনীয় মাত্রায় নেই। রাত ৯টা বাজলেই কুমিল্লা মহানগরী ও আশ পাশের উপজেলা থেকে ছুটে আসে শতশত মানুষ কুমিল্লা স্টেডিয়ামে।
গত বৃহষ্পতিবার রাত ১০টায় কুমিল্লা স্টেডিয়ামে গিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে। হাউজির মাঠটিকে আকর্ষনীয় করার জন্যে বিশাল ত্রিপলের প্যান্ডেল তৈরী করা হয়েছে। এর মধ্যে কলার মঞ্চ, উজ্জল লাইট,সিসি ক্যামেরা,এল ই ডি মনিটর, ২১টি সিলিং ফ্যান লাগিয়ে আকর্ষনীয় করা হয়েছে।আরো রয়েছে সাউন্ড সিসটেম মাইক। এর মধ্যে নিজস্ব তত্বাবধানে নিরাপত্তার জন্যে বেশ কজনকে দেখাগেছে হাতে ম্যাটাল ডিটিক্টর মেসিন নিয়ে ঘুরছে। হাউজি খেলোয়াদের জন্যে রয়েছে বিশুদ্ধ পানি পানের ব্যবস্থা। হাউজি খেলোয়ারদের জন্যে বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে কলম হার্ডবোর্ড ও ক্লিপ। স্টেডিয়ামের গেইটের বাইরে সামনের খালি জায়গাগুলোতে অন্তত ১শ হাইএক্স ও প্রাইভেট কার অবস্থান করছে। এই গাড়ীগুলোতে চরে দূরদূরান্তের মানুষ এসেছেন কুমিল্লা স্টেডিয়ামে হাউজি খেলতে এবং বাম্পার রাউন্ডে ৫ লাখটাকা পাবার আশায়। ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর রাতটি ছিল আশুরার রাত। এই রাতে কুমিল্লার মসজিদে চলছিল ইবাদত মিলাদ জিকির আর স্টেডিয়ামে চলছিল হাউজির নামে জুয়া। পরিচিত অনেকেই দেখাগেলো হাউজিতে । তারা সবাই হাউজি খেলায় ব্যস্ত। দু একজনের সাথে কথা হলো।
কুমিল্লা স্টেডিয়ামে চলছে এখন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় হাউজি। খেলা এখন প্রতিদিনই চলে তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও লোভনীয় আসরটি বসে শুক্রবারে। কারণ এইদিনে রাত ১২টার দিকে বাম্পার রাউন্ড খেলা হয় যিনি জিতবেন তিনি পাবেন ৫ লাখ টাকা। আর এই ৫লাখ টাকা ও আকর্ষনীয় পুরস্কারের লোভে প্রায় ১ হাজার মানুষ এই খেলায় অংশ নেয়। প্রতিটি সিটের মূল্য থাকে আড়াই হাজার টাকা করে। এই খেলায় একজন ৫লাখ টাকা পেলেও বাকি সবাই বিফল মননিয়ে খালি হাতে বাড়ী ফিরেন। খবর নিয়ে জানাগেছে কুমিল্লা স্টেডিয়ামে আগেও হাউজি হতো সেটা ছিল নিছক আনন্দ বিনোদন ও সময় কাটানো খেলার জন্যে,টাকার পরিমানও ছিল সহনীয়। আগে একজন লোক ৫শ টাকা ব্যয় করলেই হাউজির সবগুলো রাউন্ড খেলতে পারতো। তবে এখন যেটা হচ্চে সেটাকে বড় ধরণের জুয়া বলা যায়। এখন একজন লোক হাউজির সবগুলো রাউন্ড খেলতে হলে তাকে ৪ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। জানাগেছে বড়মাপের এই হাউজি খেলাটি পরিচালনা করার জন্যে ঢাকা থেকে হাউজি পরিচালনাকারীদের আমন্ত্রন করে আনা হয়েছে। এটি পরিচালনার মূল দ্বায়িত্বে রয়েছেন মোঃ এলাহি এবং মোঃ আলমগীর। এই হাউজি পরিচালনা ম্যানেজার হলেন মোঃ আজগর। কলার হিসেবে রয়েছেন মাহবুব ও কাজল। কুমিল্লার কিছু প্রভাবশালী লোক এই হাউজিটির নেপত্তে রয়েছেন।
এই হাউজি খেলায় নিমিত অংশ নেন এবং হাউজি সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন জানান , হাউজির মালিক শুক্রবারে সব খরচ বাদ দিয়ে কুমিল্লা থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০লাখ টাকা (কম বেশী হতে পারে) নিয়ে যান। এছাড়া প্রতিদিনই ২০ রাউন্ড করে যে খেলা হয় সে খেলাগুলো ছোট আকারে হলেও সেসব খেলায় অনন্ত ১২শ লোক অংশ নেয়। সেই দিন গুলোতে হাউজির মালিক প্রতিদিন সব খরচ বাদে কুমিল্লা থেকে প্রায় দেড়লাখ টাকা নিয়ে যান। আর এই হাউজির লাভের কিছু অংশ ভোগ করেছেন কুমিল্লা স্টেডিয়ামের প্রভাবশালী দুই একজন।
খবর নিয়ে আরো জানাগেছে একরাতেই ধণী হবার আশায় এই হাউজি খেলার নেশায় ডুবছে কুমিল্লার যুবসমাজ। কুমিল্লা সহ আশপাশের উপজেলা এমনকি ঢাকা,নারায়নগঞ্জ নোয়াখালি,লক্ষিপুর,ফেনী, ও উত্তর বঙ্গের জুয়ারীরা আসেন হাউজি খেলতে। আর হাউজি খেলার টাকা যোগারের জন্যে অনেকে পরিবারের জমানো টাকা,স্ত্রীর গহনা কানের দুল .মোবাইল ফোন বিক্রি করে টাকা জোগার করে হাউজি খেলছে। আবার অনেকে টাকা না পেয়ে ছিনতাই,চুরি, ঋন করা সহ নানাহ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এতো অধিক সংখ্যক টাকা ব্যয় করে হাউজি খেলার ফলে সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ নিঃস্ব হয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
হাউজি সপ্তাহে সাতদিনই খেলা হয়। এর মধ্যে শুক্রবার হয় আসল খেলা ঐ দিন হাউজির মাঠে প্রায় গড়ে ২ হাজার লোক হয়। এর মধ্যে ১ থেকে ২০ রাউন্ড বাম্পারসহ হাউজি খেলে গড়ে প্রায় ৫০০ হাজার লোক । প্রতিদিন চেয়ার বসানো থাকে ৭শ শুক্রবারে চেয়ারের সংখ্যা আরো ৪শ বাড়িয়ে মোট ১১ শ চেয়ার বসানো হয়। এছাড়া দাঁড়িয়ে ও হাউজি খেলে থাকেন অনেকে। প্রতিদিন হাউজির সিটের মূল্য ৩০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত ২০ রাউন্ড খেলা হয় । এতে ফুল রাউন্ড খেলায় অংশ নেয় প্রতিদিন কম পক্ষে ৫ শ লোক। বাকিরা ইচ্ছা মাফিক খেলে থাকেন। নগরী ও আশপাশ উপজেলার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ হবার পর রাত পৌনে ৯টা থেকে হাউজি খেলা শুরু হয়ে রাত ১২ টা পর্যন্ত খেলা চলে।
জানাগেছে শুধুমাত্র ৫লাখ টাকা পাবার আশায় বাম্পার রাউন্ড যদি কমপক্ষে আনুমানিক ১হাজার লোকও হাউজি খেলেন তাহলে সিট বিক্রির টাকার পরিমান আসে ২৫ লাখ টাকা। বিজয়ীরা পাবে ৫লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এতে মালিকের লাভ হয় প্রায় সাড়ে ১৯লাখ টাকা। আর অন্যন্য বাকী ১৯ রাউন্ড ৩০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করে সিটের মূল্যের হাউজি খেলার লাভের কথা হিসেব করলে এর অংক দাঁড়ায় বিশাল। ৩শ টাকা মূল্যে হাউজির সিটে খেলে থাকেন প্রায় ৫শ লোক,্এতে টাকা উঠে প্রায় একলাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা বিজয়ীকে দেয় হয় ৫০ হাজার টাকা। আরো জানাগেছে এ পর্যন্ত গত দেড় মাসে কুমিল্লার কোন লোক হাউজিতে ৫লাখ টাকা পায়নি। পেয়েছে বেশীর ভাগ উত্তর বঙ্গের লোকজন।
এই হাউজি খেলা থেকে কুমিল্লা ষ্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ কতটাকা পায়? এই হাউজি থেকে সরকারী কোন সংস্থা টাকা পায়কিনা? এই হাউজির নেপত্ত্বে কারা আছে এমন আরো কিছু এমন প্রশ্ন জানতে সোমবার দুপুরে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আহসান ফারুক রোমেনের কাছে গেলে তিনি হাউজি প্রসঙ্গে কোন তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী এক প্রশ্নের উত্তরে হাউজি থেকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের অধিনস্থ কুমিল্লা স্টেশন ক্লাব ও মহিলা ষ্টেশন ক্লাব সপ্তাহে ৪ হাজার করে পায় বলে সিটিভি নিউজকে জানান ।
এই হাউজি খেলা প্রসঙ্গে কথা বলেন, কুমিল্লা সচেতন সাগরিক কমিটির সভাপতি বদরুল হুদা জেনু ,তিনি বলেন এ ধরণের বড়মাপের বানিজ্যিক হাউজি খেলার আয়োজন জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাজ না। তবে নির্দিস্ট সময়ে ছোটআকারে নিছক বিনোদনের জন্যে হতে পারে,এর আয় থেকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধিনস্থ ক্লাবগুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে কিনা সে বিষয়টাও জানতে হবে। আর এই হাউজির ফলে সমাজে অপরাধ প্রবনতা বেড়েযেতে পারে ,প্রশাসনের নজরদারী বাড়ানো দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর এডভোকেট মাসুদ সালাউদ্দিন বলেন, আমি হাউজিকে সমর্থন করি ,বিনোদনের জন্যে হাউজি চলতে পারে তবে সেটা হতে হবে সহনীয় পর্যায়ে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে, ক্লাবে হতেপারে। তবে যা জানলাম কুমিল্লা স্টেডিয়ামের বর্তমান হাউজি খেলাটি আর সীমিত আকারে নেই। এটি এখন বড়মাপের হয়েগেছে। এটাতে যদি আশক্তি চলে আসে, তাহলে সামাজিক ব্যাধী তৈরী হতে পারে, যাতে করে হাউজি খেলার টাকার জন্যে কেউ কোন অপকর্ম না করে যে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
জেলা দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব শাহ মোঃ আলমগীর খান বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে হাউজি খেলা ইসলাম সমর্থন করেনা। বর্তমানে যে ভাবে হাউজি খেলা হচ্ছে এটির লোভে পড়ে মানুষ আশক্ত হয়ে পড়বে,অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে মানুষ,এতেকরে পারিবারিক সামাজিক অশান্তি বাড়বে।
হাউজি প্রসঙ্গে কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মাহাবুবুর রহমান বলেন, কুমিল্লা স্টেডিয়ামে আগেও হাউজি খেলা হতো সেটা আমরা দেখেছি তবে সেটা ছিল সহনশীল, ভাঙ্গা টুল টেবিলে বসে রিকসাওয়ালা,পান দোকানদারসহ অনেকে খেলতো টাকাও তেমন টাকা খরচ হতোনা। বিনোদন হতো। তবে এখন যেটা হচ্ছে শুনেছি খুব জাকজমকভাবে বড় বাম্পার লাখ লাখ টাকা ,মানুষ প্রতিদিন তিন ,চার হাজার টাকা খরচ করে হাউজি খেলছে। এতো টাকা ব্যয় করলে মানুষ দেওলিয়া হয়ে পড়তে পারে। এবং সমাজিক অশান্তি সৃস্টি হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
২৪ সেপ্টেম্বর সোমবার বিকেলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আহসান ফারুক রোমেন প্রতিবেদককে মোবাইলে ফোন করে হাউজি সংক্রান্ত তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করার বিষয়ে দূঃখ প্রকাশ করেন এবং সন্ধ্যায় তার কার্যালয়ে আমন্ত্রন জানান। সন্ধ্যায় জনাব নাজমুল আহসান ফারুক রোমেন জানান, হাউজির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই তথ্যটি সঠিক নয়। কুমিল্লা স্টেডিয়ামের ক্লাবগুলোর উন্নয়নের স্বার্থেই এই হাউজি চালু করা হয়েছে। আপনারা জানেন যে ঢাকাতে মোহামেডান,আবাহনী,সহ বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে হাউজি হয়ে থাকে। হাউজির লাভের টাকাতেই ক্লাবগুলো চলে থাকে। কুমিল্লা স্টেডিয়ামেও বহুবছর ধরেই সন্ধ্যার পর হাউজি খেলা হয়ে থাকে তবে ঐ খেলা থেকে উল্লেখ করার মতো তেমন কোন টাকা পাওয়া যায়না। এই সামান্য টাকা দিয়ে ক্লাবের ও খেলাধূলার উন্নয়ন করা সম্ভব নয় বিধায় সকলের সাথে আলোচনা করে ঢাকার হাউজির পার্টিকে অনুরোধ করে কুমিল্লা আনা হয়েছে। এখন মুটামুটি খেলা জমে উঠেছে। আমার একটা টারগেট আছে আগামী তিন বছরে যদি ৫০লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পারি তা হলে ক্লাবগুলোর উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। আর হাউজির পার্টি কত টাকা লাভ করে সেটা আমরা খেয়াল রাখছি। আর কুমিল্লা স্টেডিয়ামে মাইক্রোবাসে চড়ে যারা হাউজি খেলতে আসে তারা বেশীর ভাগই কুমিল্লার বাইরের খেলোয়ার । আর এসব খেলোয়ারদেরকে এখানে আনতে হাউজির মালিক এসব হাই্এক্স মাইক্রোবাস ও বাসের ভাড়া পরিশোধ করে থাকেন। তবে শুক্রবার ছাড়া বাকী সব দিন হাউজি তেমন জমে উঠেনা। আর হাউজি সম্পর্কে আপনাদের যে তথ্য ও পরিসংখ্যান দিচ্ছেন তা সঠিক নয়। হাউজির ব্যবসা যতটা সহজ মনে করা হচ্ছে আর যত লাভ মনে করা হচ্ছে, তত না। আমার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ নেই স্টেডিয়ামের স্বাথেই আমি কাজ করছি।