কলকাতা-চেন্নাই নয়, কুমিল্লাতেই হৃদরোগের ভালো চিকিৎসা
ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘ভালো চিকিৎসা সেবা’ কোথায় মিলবে? রোগী এমন পরামর্শ চাইলে এদেশে সাধারণত উত্তর আসে, ভারতের কলকাতা অথবা চেন্নাই কিংবা ব্যাঙ্গালুরু শহরের নাম। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার নামও আসে। তবে বৃহত্তর কুমিল্লা বা নোয়াখালী অঞ্চলে এখন কেবল কলকাতা-চেন্নাই বা সিঙ্গাপুর সিটি-ব্যাংককের নাম বলা হয় না, বরং সর্বাগ্রে বলা হয় কুমিল্লারই কথা।
আর যদি হার্ট অ্যাটাক বা যে কোনো হৃদরোগের ‘সময়োপযোগী’ এবং ‘সর্বাধুনিক’ চিকিৎসার জন্য পরামর্শ চাওয়া হয়, তবে দেশের পূর্বাঞ্চলের এই বৃহত্তর এলাকার মানুষ লম্বা সময়ের পথ ঢাকার বদলে কুমিল্লারই নাম শোনে।
‘হৃদরোগের সময়োপযোগী সর্বাধুনিক ভালো সেবা’ দিয়ে কুমিল্লা নামের জন্য এই আলোটা ছড়াচ্ছে এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউট। ভারতের বিখ্যাত ফরটিস এসকর্টস হার্ট ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের সহযোগিতায় দুই বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও খুলনায় দু’টি ইউনিট স্থাপনের পর এবার কুমিল্লায় এই হার্ট ইনস্টিটিউট খুলেছে বাংলাদেশের এএফসি (অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যাল) হেলথ লিমিটেড।
এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউটে রোগীদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছেএই হাসপাতালের সুনাম ছড়াতে ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’র ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে রোগী আর তার স্বজনদেরই। তাই, বছরখানেক আগেও বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী বা কুমিল্লা অঞ্চলের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর বা কুমিল্লার মানুষ আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে যানজট ঠেলে দূরের পথ ঢাকায় ছুটলেও এখন তারা শরণাপন্ন হচ্ছেন কুমিল্লার আড়াইওরার আলেখারচরের এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউটে। গত বছরের নভেম্বরে ইনস্টিটিউটটি কুমিল্লায় সেবা দেওয়া শুরু করার পর প্রতিমাসেই তাদের ২০-২৫ শতাংশ হারে রোগী বাড়ছে। এমনকি ঢাকায় কোনো হাসপাতালে চাকরি করা কর্মকর্তাও তার অসুস্থ বাবাকে ভর্তি করাচ্ছেন এএফসি ফরটিস ইনস্টিটিউটে।
কোটবাড়ির মৎস্য খামারী হারুনুর রশিদের (৬০) হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর গত ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে এএফসি ফরটিস ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এনজিওপ্লাস্টির পর তাকে তিন দিনের মাথায়ই হাসপাতাল ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি এখনো হাসপাতাল ছাড়েননি।
সোমবার (১ অক্টোবর) হাসপাতালের ওয়ার্ডে কথা হচ্ছিল এই সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। বাংলানিউজকে প্রায় সুস্থ এই রোগী বলছিলেন, খামারে কাজ করতে গিয়ে ব্যথা উঠে যখন পড়ে যাই, তখন ভেবেছিলাম আর বাঁচতে পারবো না। কিন্তু এই হাসপাতালের ডাক্তারের উছিলায় আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
রোগীর স্বজনদের এনজিওগ্রাম পরীক্ষার রিপোর্ট ব্রিফ করছেন ডা. এস এম মামুন ইকবালভালো সেবাপ্রাপ্তির খবরে তার ছোট মেয়ের শাশুড়ী এবং এলাকার চেয়ারম্যানসহ তিনজন রোগী এখানে সেবা নিতে এসেছে।
কুমিল্লা এবং ঢাকার হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে রশিদ বলেন, একবার আমার মূত্রনালী বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটি হাসপাতালে রাত ১১টায় গিয়ে পরের দিন বেলা ১১টায় ডাক্তারের মুখ দেখেছি। আর ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে আমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছি। যখন চেয়ারম্যান ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেছে, বলেছি কেন যাবেন? আমার স্ত্রীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছি।
চিকিৎসায় আন্তরিকতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ডাক্তার-নার্সরা সুন্দর করে কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। এখানে সবাই এতো ভালো ব্যবহার করে, মনে হয় সবাই আপন লোক। এমনকি রাতের বেলা ঘুম না হলে ডিউটি ডাক্তার এসে প্রেসার মেপে পরামর্শ দিয়ে যান, ওষুধ-বড়ি দিয়ে যান। সেজন্য এখনো বাড়ি যাইনি।
কেবল সেবার মান নয়, খরচের দিক থেকেও কুমিল্লা বা ঢাকার অনেক হাসপাতালের তুলনায় এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউটকে ভালো মনে হয় হারুনুর রশিদের কাছে।
করোনারি কেয়ার ইউনিট বা সিসিইউতে চিকিৎসাধীন চান্দিনার আবদুর রশিদ (৭৭)। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তিনিও ভেবেছিলেন বাঁচবেন না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দয়ায় চিকিৎসকদের চেষ্টায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন আবদুর রশিদ।
আবদুর রশিদেরই ছেলে ঢাকার একটি হাসপাতালে চাকরি করেন। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর তিনি পরিচিতজনদের মাধ্যমে কুমিল্লার এই হাসপাতালেই ভালো চিকিৎসার জন্য ভর্তি করিয়েছেন রশিদকে।
চিকিৎসাসেবা, খরচপাতি কেমন জানতে চাইতেই হাসলেন রশিদ। বললেন, সবকিছু ভালো বলেই তো ছেলে ঢাকায় না নিয়ে এখানে ভর্তি করিয়েছে।বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলছেন ডা. সাইফুদ্দিন এম এন আলমরোগীর সেবা নিয়ে এএফসি হেলথ ইনস্টিটিউটের ডাক্তাররা কী ভাবেন? এই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে সিনিয়র কনসালট্যান্ট-কার্ডিওলজি হিসেবে আছেন ডা. এস এম মামুন ইকবাল, ডা. এস চক্রবর্তী আছেন প্রিন্সিপাল কনসালট্যান্ট-কার্ডিওলজি হিসেবে। কার্ডিওলজির কনসালট্যান্ট হিসেবে সেবা দিচ্ছেন ডা. সাঈদ আহমেদ এবং সিনিয়র কনসালট্যান্ট-মেডিসিন হিসেবে সেবা দিচ্ছেন ডা. সাইফুদ্দিন এম এন আলম।
এএফসি ফরটিসের খুলনা ইউনিটে কাজ করে আসা ডা. মামুন ইকবাল প্রায় ৩০০০ হাজার এনজিওগ্রাম, ৫০০ এর অধিক এনজিওপ্লাস্টি, প্রায় ৫০০ প্রাইমারি পিসিআই (করোনারি এনজিওপ্লাস্টি) ও শতাধিক পেসমেকার স্থাপন করেছেন।
তার কথায়, এ দেশে ক্রমেই কার্ডিয়াক রোগী বাড়ছে। সাধারণত ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের পর শতকরা ২৫ জন প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যান। বাকিদের শতকরা ১৫ জন হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান। হার্ট অ্যাটাকের পর প্রথম ৩-৪ ঘণ্টা সময়কে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ ধরা হয়। এসময়টায় সময়োপযোগী ও আধুনিক সেবা দিতে পারলে অনেক রোগীই শঙ্কামুক্ত হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের রোগীদের, বিশেষ করে এই কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলের রোগীরা ঢাকা-চট্টগ্রামে যেতে যেতেই ‘গোল্ডেন আওয়ার’ নষ্ট করে ফেলেন। এই সময়টা যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য কুমিল্লার এএফসি ফরটিস ইনস্টিটিউট আলোকবর্তিকা।
এই ইনস্টিটিউট দিয়ে যাচ্ছে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা কার্ডিয়াক সেবা। হার্টের জটিল ও জন্মগত সমস্যা নির্ণয় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য যেমন রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের ক্যাথ ল্যাব (কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন ল্যাবরেটরি)। এর মাধ্যমে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টাই প্রাইমারি ইনজিওপ্লাস্টি সেবা দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ফরটিস এসকর্টস দিল্লির চিকিৎসকদের কনাসলটেশনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ২৪ ঘণ্টা কার্ডিয়াক ইমার্জেন্সির পাশাপাশি সর্বাধুনিক ডায়াগনস্টিক সুবিধা এবং বিশ্বমানের ডায়ালাইসিস ইউনিটও আছে এখানে। সেবার জন্য জেনারেল ওয়ার্ডের পাশাপাশি আছে ভিআইপি কেবিন, ডুয়াল কেবিন, সিঙ্গেল কেবিন।
আর খরচ? এনজিওগ্রাম ঢাকার ভালো হাসপাতালগুলোতে ২০-২৫ হাজার টাকা নিলেও ফরটিস কুমিল্লা নিচ্ছে ১৬ হাজার টাকা। পেসমেকার স্থাপনে প্রায় ঢাকার ভালো মানের হাসপাতালগুলোর মতোই খরচ ৬৫-৭০ হাজার টাকা নেওয়া হয় এখানে।
কোনো রোগী যদি মারা যান, তবে তার সবশেষ ২৪ ঘণ্টার চিকিৎসার কোনো খরচ না নেওয়ার নীতি মানছে এএফসি ফরটিস কুমিল্লা।
ইনস্টিটিউটের ফ্যাসিলিটি ডিরেক্টর রাকেশ কুমার জেয়সওয়াল তার কার্যালয়ে বসে বলছিলেন, আপাতত ৮৫ হাজার বর্গফুটের ওপর যাত্রায় স্বল্পপরিসরে সেবা দেওয়া শুরু করলেও ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত হবে এখানকার কার্যক্রম।এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউট কুমিল্লা‘প্যাশেন্ট কেয়ার’ নীতিতে বিশ্বাসী এএফসি ফরটিসে এলে কারও প্রথমে মনেই হবে না এটি হাসপাতাল। পুরো হাসপাতাল সার্বক্ষণিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। এমনকি সিসিইউতে সপ্তাহে না হলেও প্রতি ১৫ দিন পরপর জীবাণুরোধী কার্যক্রম চালানো হয়। দু’জন নারী সবসময় রোগী বা তার স্বজনদের খোঁজখবর নেন কোনো সমস্যা আছে কি-না। আর প্রতি প্যাশেন্ট বেডে একজন করে নার্স ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত থাকেন। রোগী সেবা নিয়ে বেরিয়ে গেলে আমরা খোঁজ নিই তার স্বাস্থ্যের। তারাই আমাদের হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে ইতিবাচকভাবে প্রচার করেন।
এই হাসপাতালকে বৃহত্তর কুমিল্লা-নোয়াখালীর মানুষের জন্য ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে দেখেন সৌদি আরবের কিং সাউথ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডাক্তার সাইফুদ্দিন এম এন আলম।
‘আশীর্বাদ’ হাসপাতালটির অবস্থান কুমিল্লা শহরের কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার এবং ঢাক-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আলেখারচর পয়েন্ট থেকে এক কিলোমিটারের মাঝামাঝি জায়গায়। সেবা পেতে যোগাযোগ করতে হবে এই হাসপাতালের হটলাইন ০১৭৫৫ ৬৬৮৮৮২ নম্বরে।
সূত্রঃ বাংলানিউজ২৪