লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: ১১ বছরেও চালু হয়নি তিনটি অপারেশন থিয়েটার
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ লাকসাম উপজেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোকের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অথচ এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত। সীমাহীন সমস্যার কারণে চিকিৎসা সেবার উন্নতি হয়নি। ১১ বছরেও এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিনটি অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) মধ্যে একটিও চালু করা সম্ভব হয়নি। এতে প্রসব জনিত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়। যার ফলে হতদরিদ্র, বিত্তহীন ও নি¤œ মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষগুলো সরকারি চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বুধবার রাত সাড়ে ৮ দিকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার কুন্দ্রা গ্রামের রিক্সাচালক লোকমান হোসেনের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা নাছিমা বেগমকে (২৮) প্রসব ব্যথা উঠলে হাসপাতালে আনেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তাঁর সন্তান প্রসব হয়নি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন তাঁকে অস্ত্রপাচার করতে হবে।
ভূক্তভোগী রিক্সাচালক লোকমান হোসেন জানান, হাসপাতালে অস্ত্রপাচার কক্ষ চালু না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তাঁর স্ত্রীকে শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিতে হয়েছে। সেখানে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হয়েছে। এ জন্য তাঁকে গুণতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। অবশেষে ধার-দেনা করে তাঁকে ওই টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এখন তাঁর বড্ড চিন্তা ধার-দেনা কীভাবে শোধ করবেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও বিগত ১১ বছরে বাড়েনি কোন জনবল। এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর ৭৮টি পদই শূন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ চিকিৎসা কর্মকর্তার ২৬টি পদ রয়েছে। তার মধ্যে ১৩টি পদই শূন্য। মেডিসিন, এ্যান্সেথেশিয়া, ইএনটি, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিক্স, চক্ষু, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ৬টি পদে কোনো চিকিৎসক নেই। চিকিৎসা কর্মকর্তারও ৭টি পদ শূন্য।
সূত্রে আরও জানা যায়, এখানে দু’টি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ অকেজো। অপরটি জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকম সচল রাখা হয়েছে। তা ছাড়া, সামান্য বৃষ্টি হলে এক্স-রে মেশিনের কক্ষের ছাদ চুয়ে পানি পড়ে। অপারেশন থিয়েটার (ওটি) কক্ষেরও একই অবস্থা। এখানে ডেন্টাল সার্জন না থাকায় একমাত্র ডেন্টাল ইউনিটটিও দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে রয়েছে।
পরদিন বৃহস্পতিবার বেলা এগারটায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের প্রচন্ড ভিড়। পুরো হাসপাতাল জুড়ে রয়েছেন মাত্র তিনজন চিকিৎসা কর্মকর্তা। এই তিনজন চিকিৎসক রোগী দেখে যেন হাঁপিয়ে উঠেছেন।
উপজেলার হামিরাবাগ গ্রামের আমিরজান বিবি (৬০) বলেন, (স্থানীয় ভাষায়) বা-বু-রে সাকাল ন-ডা (নয়টা) বাজে আই লাইনো খাড়াইছি। হ-রা-য় (প্রায়) অন এগারোডা বাজের। অনও ডাক্তর দেয়াইতাম হারিনো। বাড়িত যাইয়ুম কত্তনে (কখন)।
হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. আবদুল বারী রুবেল জানান, আমরা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে আন্তরিক ভাবে চেষ্ঠা করছি। কিন্তু সংখ্যক চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে প্রতিদিন বর্হিঃ বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা ৩-৪শ এবং ভর্তি রোগীদের মানসম্মত সেবা দেওয়া অত্যন্ত দূরহ।
উপজেলার গাজিরপাড় গ্রামের হতদরিদ্র মরিয়ম বেগম (৪৮) জানান, দীর্ঘদিন থেকে তিনি মাথা ব্যথা ও চোখের সমস্যায় ভুগছেন। তিনি এসেছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে। কিন্তু এখানে চক্ষু চিকিৎসক না থাকায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক দেখানো এবং ওষুধ কেনার মত তাঁর সামর্থ নেই। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর পরিসংখ্যানবিদ তাসলিমা আক্তার জানান, হাসপাতালের একমাত্র আবাসিক চিকিৎসকের (আরএমও) পদটিও রয়েছে শূন্য। কাগুজে-কলমে এখানে একজন ডেন্টাল সার্জন থাকলেও তিনি প্রেষণে রয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সহকারী সার্জনের ১০টি পদের মধ্যে ৫টি পদই শূন্য। তদুপরি ২০০৯ সাল থেকে একজন রয়েছেন অনুমোদিত অনুপস্থিত। তিনি আরও জানান, ফার্মসিষ্টের পাঁচটি পদ থাকলেও ১০ চার বছর ধরে এগুলো শূন্য রয়েছে। প্রধান সহকারীর একমাত্র পদটিও শূন্য। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের তিনটি পদের একটিতেও কেউ নেই। ষ্টোর কিপার, ক্যাশিয়ার, এস.এ.সি.এমও, মেডিকেল টেকনেশিয়ান (ল্যাবরোটারি), মেডিকেল টেকনেশিয়ান (ফিজিওথেরাপি), কার্ড্রওিগ্রাফার, কম্পাউন্ডার, অপারেশন থিয়েটার এটেনডেন্ট এবং জরুরী বিভাগ এটেনডেন্ট এর পদও রয়েছে শূন্য। সেবিকার (নার্স) পদে ১টি এবং স্বাস্থ্য সহকারীর ২৮টি পদের মধ্যে ১১টি পদই শূন্য রয়েছে। তন্মধ্যেও একজন কুমিল্লা সিভিল সার্জন’র কার্যালয়ে প্রেষনে রয়েছে। ওয়ার্ড বয় এর তিনটি পদই শূন্য। এ ছাড়াও আয়া, বাবুর্চি, মশালচি, মালী, নিরাপত্তা প্রহরী পদে কোনো লোক নেই। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর ৫টি পদের সবগুলো পদই শূন্য রয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ বি এম মশিউল আলম বলেন, এখানে চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল সংকট চরমে। বিশেষ এ্যান্সেথেশিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং অপারেশন থিয়েটার (ওটি) এটেনডেন্ট না থাকায় ওটি চালু করতে পারছেন না। এ ছাড়া, ওয়ার্ড বয়, আয়া, নিরাপত্তা প্রহরী এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি নেই। নানাবিদ সমস্যা ও সংকটের কারণে একদিকে যেমন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দৈনন্দিন কাজকর্মে বিঘœ ঘটছে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতত কর্তপক্ষের কাছে বহু আবেদন-নিবেদন করেও কোনো সাড়া মিলেনি বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান মুঠোফোনে জানান, গত সপ্তাহে তিনি লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেছেন। ওই সময় তিনি জানান, শীঘ্রই একজন এ্যান্সেথেশিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেওয়া হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চালুকরণসহ কতিপয় সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা দক্ষতার সাথে এসব সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে তাঁকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। জনবল সংকটের ব্যাপারে সিভিল সার্জন বলেন, পুরো জেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কমপক্ষে এক হাজার পদ শূন্য। এ ছাড়া, ২০১৫ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনও বন্ধ রয়েছে। জেলার প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একই চিত্র। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতত কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।