কুমিল্লার গোমতী এখন মরা নদী
মারুফ আহমেদঃ কুমিল্লার প্রধান নদী গোমতী। এক সময়ের খরস্রোতা গোমতী এখন মরা নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় উৎপন্ন নদীটি কুমিল্লা সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী কটকবাজার এলাকা দিয়ে এদেশে প্রবেশ করে। একসময় নদীটি কুমিল্লা শহর হুমকীর কারণ হলেও বিগত শতকের ষাটের দশকে গতিপথ পরিবর্তন করে শহরের উত্তর পাশে সরিয়ে নেয়। নদীটি দাউদকান্দিতে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। নদীতে একসময় পাল তোলা নৌকায় মালামালসহ লোকজন নদী তীরের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছলেও কালের বিবর্তনে নদীটি এখন নৌকা শূণ্য। এক সময়ে তীব্র খরস্রোতের কারণে বর্ষায় নদী তীরের লাখ লাখ মানুষ ভাঙ্গনের আশঙ্কায় দিন-রাত প্রতিরক্ষা বাঁধ পাহাড়া দিলেও এখন আর সেই যৌবনও নেই। শুস্ক মৌসুমে নদীটির কোথাও কোথাও হাটু সমান , আর বর্ষায় বহুদিন ধরে নদীর দু-কুল উপচে পড়েনা পানির ঢল।
এঅবস্থায় দিন দিন বাড়ছে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ভিতর পাকা স্থাপনা নির্মান,আবার কেউবা নদীর মালিকানা দাবী করে বনায়ন করছে দীর্ঘ সময় ধরে। দায়িত্বশীল নির্ভরযোগ্য সুত্র জানায়,নদীর উজানে ভারতীয় অংশে বাঁধ দিয়ে পাহাড়ে পানি সরিয়ে নেওয়ায় দিন দিন নদীটি পানি শুণ্য হয়ে পড়ছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্য অ ল ডুমুর এলাকায় উৎপন্ন গোমতী কুমিল্লার কটকবাজার সীমান্ত পথে প্রবেশ করে। অসংখ্য আকাঁবাকাঁ নদীটি কুমিল্লা শহরের উত্তরপাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে ময়নামতি সেনানিবাস সংলগ্নস্থানে গিয়ে আবারো উত্তর দিকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়।
এসময় বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবীদ্বার, মুরাদনগর এ চারটি উপজেলা হয়ে পশ্চিমে তিতাসের কিছুটা অংশ দিয়ে দাউদকান্দির শাপটা এলাকায় মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। কুমিল্লা শহরছাড়াও নদীটি ময়নামতি সেনানিবাস,ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক,কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশাপাশি প্রবাহিত হওয়ায় নদীটির ডান দিকে তিতাসের দাসকান্দি পর্যন্ত অংশে রয়েছে ৬৫ কিলোমিটার এবং বাম দিকে ইলিয়টগঞ্জ পর্যন্ত ৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য । নদীটির প্রশস্ততা কটকবাজার থেকে দাউদকান্দির গৌরীপুর পর্যন্ত ৫০-৬০ মিটার এবং গৌরীপুরের পর থেকে মেঘনা পর্যন্ত অংশ ৭০-৮০ মিটার। মূল নদীটির গভীরতা ৭ মিটারের কিছু বেশী।
একসময়ের কুমিল্লার দুঃখ গোমতী কুমিল্লা মহানগরীর গাংচর এলাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। বিগত ষাটের দশকের শুরুতে নদীটির গতিপথ পরিবর্তন করে নগরীর উত্তরপাশে চান্দপুর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সরেজমিন নদী তীরের টিক্কাচর,কাপ্তানবাজার, বানাসুয়া,পালপাড়া, বাবুবাজার, আলেখারচর, আমতলী ,কাচিয়াতলী, ভান্তি,কাঠালিয়া, বাজেবাহেরচর,পূর্বহুরা ,এতবারপুর, রামনগর,নাল্লা,কালিকাপুরসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বিগত শতাব্দির ৮০’র দশকের শেষ সময় পর্যন্ত বর্ষাকালে গোমতীর দু’তীরে বসবাসকরা লাখ লাখ মানুষ নদী ভাঙ্গনের আতঙ্কে প্রয়োজনীয় মূল্যবান মালামাল তাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি পাঠিয়ে দিন কাটাত।
চান্দপুর এলাকার মোশাররফ , ময়নামতি এলাকার বাজেবাহেরচর গ্রামের দিলীপ, ভান্তির কবীর, কাঠালিয়ার অনোয়ারসহ অনেকেই জানান, আগে প্রতিবছর বর্ষাকালে নদী তীর ভাঙ্গনের ভয়ে রাত জেগে পাহাড়া বসাত এখানকার মানুষরা। কিন্তু বিগত ৯০’এর পর থেকে নদীতে বর্ষাকালে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলেও প্রতিরক্ষা বাঁধ উপচে পড়েনা পানি। ফলে এখন আর নদী তীর ভাঙ্গনের শঙ্কায় রাত জেগে গ্রামবাসী পাহাড়া দেয়না । তারা আরো বলেন,শুস্ক মৌসুমে নদীর অবস্থা এতটাই বেহাল যে,কোথাও কোথাও পানি হাটু সমান থাকে।
নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল একাধিক সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভারত তাদের আভ্যন্তরে নদীটির বিভিন্নস্থানে একাধিক বাঁধ দিয়ে শুস্ক মৌসুমে চাষাবাদের জন্য পানি নদী থেকে সরিয়ে নেওয়ায় পানি প্রবাহে একেবারেই কম থাকে । ফলে এদেশে নদীটি শুস্ক মৌসুমে কোন কোন স্থানে পানি প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। নদীটির বাংলাদেশে প্রবেশ মুখ কটকবাজার এলাকায় স্লুইস গেট বসিয়ে বিগত ষাটের দশকে সোনাইছড়ি নামে একটি খালে গোমতীর পানি প্রবাহ সৃষ্টি করে কুমিল্লার দক্ষিণে কমপক্ষে ১০ হাজার একর জমির সেচ কাজে এই পানি ব্যবহার করলেও এখন সেই সোনাইছড়ি খালটি পানি স্বল্পতায় শুকিয়ে মৃত প্রায়। আর এর ফলে বর্ষায় দু-কূল উপচে পানি না উঠায় দিন দিন নদীর অভ্যন্তরের দখল বানিজ্য শুরু হয়েছে। কেউ কেউ নদীর ভিতরে থাকা বহুস্থান বিএস জরিপে নিজের নামে উঠিয়ে বিনোদন কেন্দ্র,বাসা-বাড়ি,ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান,খামারসহ বহুতল ভবন নির্মান করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শাওন পালিত জানান,নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ভিতর রয়েছে কমপক্ষে দু’হাজার স্থাপনা। তিনি আরো বলেন, প্রতিরক্ষাবাঁধের ভিতর থাকা কোন স্থাপনাই বৈধ না। অনেকেই সরকারী অনুদানের টাকায় গড়ে তুলছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। দিন দিন শুস্ক হওয়ায় অনেকেই নদীর ভিতর করেছে বনায়ন। আবার কেউ কেউ প্রতিদিনই যত্রতত্র মাটি কেটে বিক্রি করছে। ফলে নদীটির সৌন্দর্যও হারিয়ে গেছে ।
পঞ্চাশ দশকের পাকিস্তান জাতীয় দল ও ঢাকা মোহামেডান এর ফুটবলার ময়নামতির সিন্ধুরিয়াপাড়া গ্রামের হুমায়ুন কবীর জানান, গোমতীতে নৌকা এক সময় এই অঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল। তিনি আরো বলেন, বড় বড় মাছ পাওয়া যেত নদীতে। সেগুলো এখন আর নেই।
সদর উপজেলার নদী তীরের বিষ্ণুপুর গ্রামের আব্দুল জলিল বলেন,পাকিস্তান আমলে নদীর দু’পারের ব্যবধান এত ছিল যে,শুধু পানি আর পানি দেখা যেত। পুরো বছর নদীতে মাছ শিকার করতো নদী তীরের মানুষরা। আজ এগুলো ইতিহাস। জেলেরা জাল ফেলেনা নদীতে। তিনি আরো বলেন,বর্ষায় নদীতে স্রোত থাকলেও শুস্ক মৌসুমে নদীটি খালের আকার ধারণ করে।
এদিকে সরকারের সুষ্ঠু নজরদারীর অভাবে ইচ্ছেমাফিক জায়গা থেকে প্রভাবশালী ইজারাদাররা ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলনে নদীর উপর থাকা রেল ও সড়ক সেতুগুলো হয়ে পড়ছে হুমকীর মুখে। দেশের প্রধান ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লা সদর উপজেলার বানাসুয়া এলাকায় রেল সেতু, এর পাশে থাকা পালপাড়া ব্রীজ, পীরযাত্রাপুর এলাকার ব্রীজের পাশ থেকে ড্রেজারে করে পুরো বছরজুড়ে বালু উত্তোলনের কারণে এসকল স্থাপনা সমুহ রয়েছে হুমকীর মুখে। এছাড়াও নদী তীরে ভারী বালু ও মাটি বহনকারী ড্রাম্প ট্রাক চলাচলে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । এতে বাঁধ মেরামতে সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে প্রতিবছর।
বিষয়টি জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লা’র উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাওন পালিত বলেন,নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ভিতর থাকা সব স্থাপনাই অবৈধ। জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিটি উপজেলায় আলাদাভাবে অবৈধ স্থাপনার তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান ।